চকচকা

জমিজট, বেহাল রাস্তার ফাঁসে শিল্প

সহজ শর্তে জমি। ঋণে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি। রাস্তা, বিদ্যুৎ, জল, সবই প্রস্তুত। চকচকার শিল্পতালুকে কারখানা তৈরির সব সুবিধে রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান, “দয়া করে দূরের জেলাগুলিতে কাজ করুন। যেখানে সুযোগ কম, সেখানে কাজ করুন। আমি সহযোগিতা করব।”

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ

কোচবিহার শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৫৩
Share:

সহজ শর্তে জমি। ঋণে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি। রাস্তা, বিদ্যুৎ, জল, সবই প্রস্তুত।

Advertisement

চকচকার শিল্পতালুকে কারখানা তৈরির সব সুবিধে রয়েছে। সেই সঙ্গে আছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান, “দয়া করে দূরের জেলাগুলিতে কাজ করুন। যেখানে সুযোগ কম, সেখানে কাজ করুন। আমি সহযোগিতা করব।” নভেম্বরের গোড়ায় কোচবিহারের গুমানিরহাটে সভায় শিল্পোদ্যোগীদের কাছে এমনই আবেদন করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কোচবিহার শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে চকচকা শিল্পতালুকে তারপরেও ভাটার টান। নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে না, একে একে বন্ধ হচ্ছে পুরনোগুলি। অভিযোগ, জমি-জট আর খারাপ পরিকাঠামোর জন্য থমকে গিয়েছে শিল্পের গতি।

শিলিগুড়ির ডাবগ্রাম, জলপাইগুড়িতে রানিনগর, আর কোচবিহারের চকচকা, উত্তরবঙ্গে শিল্পতালুক বলতে এগুলিই। মালদহ, বালুরঘাট, ইসলামপুরে জমি চিহ্নিত হয়ে রয়েছে, শিল্পতালুক তৈরির কাজ দূর অস্ত। রানিনগরেও চালু হয়েছে গোটা দশেক কারখানা।

Advertisement

চকচকা শিল্পতালুকের বয়স প্রায় ১৫ বছর। শুরুটা হয়েছিল ভালই। রাইস মিল, হাসকিং মিল, প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি, খাতা তৈরি, পাটজাত সামগ্রী তৈরি, তুলাজাত সামগ্রী তৈরি, সর্ষের তেলের মিল, বিস্কুট কারখানা, পানীয় জল তৈরির কারখানা, মশারি, ইলেকট্রিকের জিনিসপত্র তৈরির কারখানা, প্যাকেট দুধ, স্টিলের আলমারি তৈরির কারখানা-সহ প্রায় ৬৫ টি কারখানা গড়ে ওঠে।

কিন্তু একদিকে কাঁচামালের অভাব, অন্য দিকে বাজার ধরতে সমস্যা, এই দু’য়ের ফলে মশারি কারখানা, বিস্কুট কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। শেষে শ্রমিক সমস্যার কথা জানিয়ে পাটজাত দ্রব্যের তৈরি একটি কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ওই কারখানা খোলার ব্যাপারে একাধিকবার বৈঠক করে আশ্বাস দেওয়া হলেও আদতে তা কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখন অবস্থা এমনই যে, ৪৫টি শিল্পের ১৫টিই কার্যত ঝাঁপ বন্ধ করেছে।

কিন্তু ওই বন্ধ কারখানাগুলি জমি দখল করে রয়েছে। সেই সঙ্গে, ২০০৭ সালে ‘জুট পার্ক’-এর জন্য বরাদ্দ ৩০ একর জমি পড়ে আছে এখনও। অথচ নতুন কারখানার জন্য আবেদন করে জমি পাচ্ছেন না শিল্পোদ্যোগীরা।

কোচবিহার ডিস্ট্রিক্ট ইন্ডাস্ট্রিজ ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সভাপতি সুকুমার সাহা বলেন, “শিল্প তৈরির আগ্রহ আছে অনেকেরই। আমি নিজেও আরেকটি কারখানা করতে চাই। কিন্তু জমি পাচ্ছি না।” শিল্পদ্যোগীদের দাবি, কোচবিহারে শিল্প তৈরির একটি বড় অন্তরায় জমি। চকচকা শিল্পকেন্দ্রের যা অবস্থা, তাতে সেখানে নতুন করে কারখানা তৈরির জমি পাওয়া যাবে না। বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা কারখানা খুলতে হবে। না হলে ওই জমি নিয়ে প্রশাসনের চিন্তাভাবনা করতে হবে। জুট পার্কের জন্য রাখা জমিতে ক্ষুদ্রশিল্প তৈরির অনুমতি দিক প্রশাসন, দাবি তাঁদের।

কিন্তু নভেম্বরের গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রী চকচকা শিল্পতালুকের ওই ৩০ একর শূন্য জমিতেই উদ্বোধন করেন জুট পার্কের। শীঘ্রই শিল্প আসবে, এমনই দাবি প্রশাসনের। যা নিয়ে সন্দিগ্ধ শিল্পোদ্যোগীরা। কোচবিহার চেম্বার অব কমার্সের পক্ষে রাজেন বৈদ বলেন, “ওই জমিতে পাট কারখানা তৈরিতে আগ্রহীরা আদৌ আসবেন কিনা, সন্দেহ আছে। একটি মাঝারি জুট মিল কয়েকদিন আগে বন্ধ হয়। আর চালু হয় নি। ওই জমিতে অন্য কারখানা তৈরির অনুমতি দেওয়া উচিত বলেই আমাদের মনে হয়।” কোচবিহারে দ্বিতীয় শিল্পকেন্দ্র তৈরির জন্যও তাঁরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছেন। তা বেশিদূর এগোয়নি।

জেলা শিল্পকেন্দ্রের আধিকারিক অভিজিৎ কর অবশ্য বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সভার পর ৩৬ জন শিল্প গড়তে চেয়ে আবেদন করেছেন। তার মধ্যে আসবাবপত্র, বাঁশের কাজ, শীতলপাটি, ডেয়ারি ইত্যাদি রয়েছে।’’ প্রশাসনের একটি সূত্রের অবশ্য দাবি, এই ‘শিল্পোদ্যোগ’ প্রক্রিয়া বেশ কয়েক মাস থেকেই চলছে। পরপর কারখানা বন্ধ হওয়ার সংকটও মানতে রাজি নন অভিজিৎবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যে দুয়েকটি আপাতত বন্ধ, সেগুলি চালুর উদ্যোগ নিয়েছি। কিছু কারখানা ও জমিও হস্তান্তর করা হয়েছে।”

তবে ঘটনা হল, নতুন সরকার আসার পর থেকে শিল্পতালুকে একের পর এক সমস্যা সামনে আসতে শুরু করে। রাস্তা, বিদ্যুৎ নিয়েও ক্ষোভ দেখা দেয়। কোচবিহার থেকে চকচকা পর্যন্ত রাস্তা ভাল হলেও, শিল্পতালুকের ভিতরে রাস্তা খারাপ। প্রায় ২৫ শতাংশ পথবাতি কাজ করছে না।

ডাবগ্রামের শিল্পতালুকও নানা সমস্যায় ধুঁকছে। ২০ বছর আগে তৈরি পরিকাঠামোর কোনও উন্নতি হয়নি, বলছে ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিস ইন নর্থ বেঙ্গল (ফোসিন)। অর্ধেক শেড পরিত্যক্ত, চলছে গোটা চল্লিশ কারখানা। নিকাশির হাল খারাপ, বর্ষা পড়লেই কোমরজল দাঁড়িয়ে যায়। ফোসিনের সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাসের কথায়, ‘‘চকচকা, ডাবগ্রাম এবং রানিগগর, তিন শিল্পতালুকেরই প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, জল, ভাল রাস্তা, নিকাশি তৈরি করা হয়নি। লগ্নির পেতে সহায়তাও করা হয়নি। তাই সব সম্ভাবনা কাগজে কলমেই রয়ে গেল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন