বালুরঘাটে সব্জি বাজার খুলেছে বৃহস্পতিবার।
দোকানপাট খুলেছে। মাছ বাজারও খুলেছে। রাস্তাঘাটে লোকজন আছে। কিন্তু, পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি বালুরঘাট। পথেঘাটে, দোকানে, চায়ের আড্ডায়, বাস স্ট্যান্ড কিছুটা থমথমে। অনেকের আলোচনায় ঘুরেফিরে যে প্রশ্ন উঠে আসছে, বুধবার যে ৪ জন দুষ্কৃতী বাজারে গিয়ে তোলা আদায় করেছিল, তাদের কেন পুলিশ ধরতে পারছে না? শুধু তাই নয়, অভিযুক্ত ৪ দুষ্কৃতীর মধ্যে অন্তত ২ জন এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে থাকলেও কেন পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না সেই প্রশ্নও উঠছে। বালুরঘাটের ব্যবসায়ীদের সমস্যা কেন মিটছে না সেই প্রশ্নে উদ্বিগ্ন ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, নর্থ বেঙ্গল (ফোসিন) সহ এখাধিক সংগঠন।
বালুরঘাটের একাধিক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, অতীতেও পুলিশকে বহুবার তোলা আদায়কারীদের অত্যাচারের ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়ে সমস্যার সমাধান হয়নি। সে জন্য তাঁরা চটজলদি পুলিশ সক্রিয় হবে বলে আশা করছেন না। তবে ব্যবসায়ীদের অন্যপক্ষ কিন্তু, হাল ছাড়তে রাজি নন। বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ী সংগঠনের কয়েকজন সদস্য জানান, তাঁরা গোটা ঘটনাটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়ে হস্তক্ষেপ চাইবেন।
ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীকে কী জানানো হবে তার খসড়াও তৈরি হয়েছে। সেখানে বালুরঘাটের বাজারপাড়া এলাকায় তোলাবাজির জাল ছড়ানোর আড়ালে কারা মদত দিয়েছেন তা জানানো হবে। কিছুদিন আগে ফোনে হুমকি দিয়ে এক দোকানের মালিকের কাছে ১ লক্ষ টাকা চাওয়ার পরেও খোকনকে গ্রেফতার করা কেন হয়নি সেই অভিযোগও জানানো হবে। বালুরঘাট ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক হরেরাম সাহা বলেন, “দুর্গাপুজোর নামে জোর করে মোটা টাকা চাঁদা আদায় থেকে তোলাবাজির অভিযোগ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শুনেছি। কেউ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করতেন না। ফলে আইনত আমরা কোনও পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এবার সুযোগ পেলে যথাস্থানে সব জানানো হবে।”
খুনের ঘটনাস্থল নিউ মার্কেট
এলাকায় দোকানপাট খোলেনি।
পরে পুলিশ গিয়ে দোকান
খোলার অনুরোধ করে।
বালুরঘাটের গীতাঞ্জলীর বাজারপাড়া এলাকার মধ্যে বুড়াকালী মন্দির লাগোয়া অঞ্চলটি মাড়োয়ারী পট্টি নামে পরিচিত। মূলত শহরের বড় ব্যবসায়ীদের বাড়ি ও দোকান ওই এলাকায়, গয়নার বড় বড় শোরুম থেকে জামাকাপড়, জুতো, বাসনপত্র মুদি, মনিহারী দোকান রয়েছে। সবজি ও মাছের মূল বাজার ওই এলাকায়। শহরের মূল ব্যবসা কেন্দ্র বলে পরিচিত ওই এলাকায় বাড়ি, দোকান ও জায়গা কেনাবেচা করতে গেলেই ‘কমিশন’ দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। এ কতা প্রায় সব ব্যবসায়ী, বাসিন্দাই জানিয়েছেন। এমনকী, বাজারের সেরা মাছ, খাসির মাংস আদায় করাটাও তোলাবাজদের রেওয়াজ। বাম আমলে ওই এলাকার দাদাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এক মাংস বিক্রেতা দোকানের অংশ জলের দরে বিক্রি করে নদীর ওপার চকভৃগু এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হন। বাড়ির সামনেই তিনি এখন মাংস বিক্রি করেন তিনি। ব্যবসায়ীরা জানান, সব তথ্যই মুখ্যমন্ত্রীকে জানানো হবে।
ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, নিহত খোকন কর্মকার তোলা আদায়ের টাকা চড়া সুদে খাটাত। এলাকায় ঠিকাদারদের অনেককেই তাঁদের কমিশন দিতে বাধ্য হতেন। পরিতোষ দে খুনের পরে পুলিশ-প্রশাসন চাপের মুখে পড়ে। কারণ, গোটা উত্তরবঙ্গেই ব্যবসায়ীরা আন্দোলনের হুমকি দেন। সেই সময়ে খোকন গ্রেফতার হন। প্রশাসন থেকে খোকনদের ক্লাব বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেখানে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চালু করা হয়। গত তিন বছর ধরে এলাকায় দুর্গাপুজোর অনুমতি দেওয়া বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। কিন্তু, খোকন জেল থেকে ফিরে ফের দাদাগিরি শুরু করেন বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।
এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দিনভর ফোনে হুমকি দিয়ে ‘ঠেক’-এ টাকা পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হতো। কেউ রাজি না হলেই খোকনের দলবল গিয়ে হাঙ্গামা বাধাঁত বলে অভিযোগ। ওই বাজারে নিত্য যাতায়াত করেন, এমন অনেক বাসিন্দার প্রশ্ন, ‘দিনের পর দিন এমন তোলা আদায় চলছে দেখে পুলিশ-প্রশাসন, নেতা-কর্তা, গোয়েন্দারা কেন নীরব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।”
তোলাবাজিতে অভিযুক্ত শিবু কাহারের ভাঙচুর হওয়া বাড়ি।
বস্তুত, বালুরঘাটের ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন উত্তরবঙ্গের অন্য জেলার ব্যবসায়ী মহলও। উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফোসিনের সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “আমরা কিছুদিনের মধ্যে রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের আইজি’র সঙ্গে দেখা করে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার কথা জানাব। বালুরঘাটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। এলাকার নজরদারি বাড়ানোর জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কোনও এলাকা থেকে তোলাবাজি, হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ পেলেই আমরা পুলিশ-প্রশাসনকে জানাই।” নর্থ বেঙ্গল চেম্বার অব কর্মাসের মুখপাত্র সমরেন্দ্র প্রসাদ বিশ্বাসও ব্যবসায়ীদের থেকে জবরদস্তি টাকা আদায়ের প্রবণতা নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, “পুলিশ প্রশাসনকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। আবারও করব। বালুরঘাটের ঘটনার পরে পুলিশের আরও সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।” জলপাইগুড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সাধন বসু জানান, তাঁরা বালুরঘাটের ব্যবসায়ীদের পাশে থাকার ব্যাপার বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেন, “বালুরঘাটে পুলিশ নিশ্চয়ই ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। আমরা সব জায়গায় বিষয়টি জানিয়ে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ করব।”
ছবি: অমিত মোহান্ত