দোলের দিনেও নহবত বাজল না মদনমোহন মন্দিরে

নহবতের সুরে আর ঘুম ভাঙছে না মদনমোহন দেবের। এমনকী দোলপূর্ণিমার সকালেও মদনমোহন মন্দির থেকে ছড়িয়ে পড়ল না নহবতের সুর। এত দিনের রেওয়াজ ভাঙায় বিষণ্ণ কোচবিহার। কোচবিহারের শতাব্দী প্রাচীন মদনমোহন মন্দিরে বিগ্রহকে ঘুম থেকে তুলতে সানাই, নাগরা, জুড়ি, করতালের মিলিত ‘নহবত’ বেজে ওঠার প্রথা রয়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ওই সুরে ভেসে যেত গোটা মন্দির চত্বর। শহরের লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের কানেও পৌঁছে যেত সেই সুর। সানাইদারের মৃত্যুর ফলে প্রায় তিন মাস ধরে সেই নহবত আর বাজছে না।

Advertisement

অরিন্দম সাহা

কোচবিহার শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৫ ০১:৪৯
Share:

কোচবিহারে মদনমোহন মন্দিরে দোল উত্সব। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

নহবতের সুরে আর ঘুম ভাঙছে না মদনমোহন দেবের। এমনকী দোলপূর্ণিমার সকালেও মদনমোহন মন্দির থেকে ছড়িয়ে পড়ল না নহবতের সুর। এত দিনের রেওয়াজ ভাঙায় বিষণ্ণ কোচবিহার।

Advertisement

কোচবিহারের শতাব্দী প্রাচীন মদনমোহন মন্দিরে বিগ্রহকে ঘুম থেকে তুলতে সানাই, নাগরা, জুড়ি, করতালের মিলিত ‘নহবত’ বেজে ওঠার প্রথা রয়েছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ওই সুরে ভেসে যেত গোটা মন্দির চত্বর। শহরের লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের কানেও পৌঁছে যেত সেই সুর। সানাইদারের মৃত্যুর ফলে প্রায় তিন মাস ধরে সেই নহবত আর বাজছে না। মন্দির চত্বরের নহবতখানার ঘরে ধুলো জমছে ওই সব বাদ্যযন্ত্রে। বিগ্রহ স্নান করানো কিংবা সন্ধ্যা আরতির সময়েও ‘লাইভ নহবত’ বন্ধ। অভিযোগ, অথচ এত দিনেও বিকল্প বন্দোবস্ত করে পরম্পরা রক্ষায় ফের নহবত বাজানোর ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। এমনকী, কবে ফের প্রাচীন রীতি মেনে ওই ব্যবস্থা চালু করা হবে, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলছেন না। সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে শুধু একবার সন্ধ্যায় আধ ঘন্টার জন্য ক্যাসেট বাজিয়ে দায় সারা হচ্ছে। এ নিয়ে কোচবিহারের বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের ভূমিকা নিয়েও।

দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডের সভাপতি তথা কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন অবশ্য বলেছেন, “প্রাচীন রীতি যা ছিল তাই থাকবে। বোর্ডের বৈঠকে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে উদ্যোগী হচ্ছি।” বোর্ডের সদস্য কোচবিহারের সদর মহকুমা শাসক বিকাশ সাহা বলেন, “গত ডিসেম্বরে সানাইবাদকের মৃত্যুর জেরে সমস্যা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়ভাবে খোঁজ করেও অভিজ্ঞ শিল্পী পাওয়া যায়নি। বারানসী থেকে বিকল্প শিল্পী ফের এনে নহবত বাজানোর প্রক্রিয়া চালুর সব রকম চেষ্টা হচ্ছে।”

Advertisement

দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ড সূত্রেই জানা গিয়েছে, ১৮৯০ সালের ২১ মার্চ কোচবিহারের বৈরাগী দিঘির পাড়ে ওই মন্দিরে মদনমোহন দেবের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়। মন্দিরের মূল প্রবেশ দ্বারের উপরে নহবতখানার জন্য নির্দিষ্ট ঘর তৈরি হয়। তারপর থেকেই প্রচলিত বিশ্বাস মেনে নহবতের সুরে বিগ্রহ জাগিয়ে তোলার রেওয়াজ চালু হয়। সে সময় কাশী থেকে কোচবিহারে আসা শিল্পীরা নহবতে সুর তুলতেন। ‘সানাইদার’ হিসেবে সেই শিল্পী আমৃত্যু কাজ করেছেন এখানেই। তাঁর পূর্বসূরিরাও আদতে কাশীর বাসিন্দা ছিলেন। কোচবিহার রাজ পরিবারের অমিয় দেববক্সি বলেন, “মহারাজা কাশী থেকে শিল্পীদের এনে নহবত চালু করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে দৈনিক তিন বার ওই নহবত বাজাতেন শিল্পীরা।” তাঁর কথায়, “কারণ যাই হোক, নহবতের বাজনা বন্ধ থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার জানিয়েছেন, রাজধানী কোচবিহারের নহবতের ইতিহাস অন্তত ২০০ বছরের পুরোনো। রাজাদের ইতিহাসের সঙ্গে নহবত সম্পর্কিত নানা তথ্য জড়িয়ে রয়েছে। ১৮২৮ সালে মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ কোচবিহারে বিশালাকার রাজপ্রাসাদ তৈরি করেন। সেই রাজপ্রসাদের সামনেও নহবতখানা তৈরি করা হয়েছিল। ১৮৮৭ সালে কোচবিহারে নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলে নতুন রাজবাড়ি ও ১৮৯০ সালে মদনমোহন মন্দির তৈরি হয়। মন্দিরের সামনের গেটের উপর তৈরি সেই নহবতখানার বাজনা এ ভাবে কোনও দিন বন্ধ হয়নি।

দেবোত্তর ট্রাস্ট সূত্রেই জানা গিয়েছে, এক সময় চারজন শিল্পী ছিলেন। দুই বছর আগে মন্দিরে নহবতের সুরে রাজার শহরের ঘুম ভাঙাতে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে সাউন্ড সিস্টেমের পরিকাঠামোও তৈরি করা হয়। শহরবাসী দূর অস্ৎ, এখন বিগ্রহ জাগিয়ে তোলার জন্য নহবতই বাজছে না। সন্ধ্যায় ভরসা প্রায় সমসুরের ক্যাসেট। এক কর্মী তো বলেই দিলেন, “সকালে ক্যাসেট বাজাতে আসতেও কেউ রাজি নন। তাই পাখির কলতানেই বিগ্রহ জাগছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন