নকশি কাঁথায় স্বপ্ন বোনেন এপারের রাহেলারা

পুলিশের ভয়ে স্বামী ফেরার হওয়ার পর থেকে বিরহের দিন শেষ হয় না সাজুর। দুঃসাহসী বাদিয়া যুবক রুপাইয়ের সঙ্গে কাটানো দিন, নিজের ব্যথা আর জীবন-যন্ত্রণার ছবি নকশি কাঁথায় বুনতে থাকে সে।

Advertisement

বাপি মজুমদার

চাঁচল শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৫ ০২:৪১
Share:

খানপুরে কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত মহিলারা। —নিজস্ব চিত্র।

পুলিশের ভয়ে স্বামী ফেরার হওয়ার পর থেকে বিরহের দিন শেষ হয় না সাজুর। দুঃসাহসী বাদিয়া যুবক রুপাইয়ের সঙ্গে কাটানো দিন, নিজের ব্যথা আর জীবন-যন্ত্রণার ছবি নকশি কাঁথায় বুনতে থাকে সে।

Advertisement

কাব্যগ্রন্থের পটভূমি ওপার বাংলা। কিন্তু ওপারের কবিতার চিত্ররূপের বাস্তবে দেখা মেলে মালদহের চাঁচলের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা শেরশাবাদিয়া সমাজেও। ভোরবেলায় স্নান, খাওয়া সেরে পরিবারের পুরুষেরা বেরিয়ে পড়েন কাজের খোঁজে। অবসরে তখন সূচ-সুতো হাতে বসে পড়েন শেরশাবাদিয়া মহিলারা। মূলত দারিদ্রের তাড়নায়, প্রয়োজন মেটাতে কাঁথা সেলাই করলেও তাঁদের উপার্জনের পথও দেখাচ্ছে এই নকশি কাঁথাই। নকশি কাঁথার হাত ধরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকলেও প্রশাসনের তরফে কোনও সাহায্যই মেলে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

চাঁচলের মহকুমাশাসক পোন্নমবলম এস বলেন, ‘‘স্বনির্ভর দল ছাড়া প্রশাসন কোনও সাহায্য করতে পারে না। দল গড়ে ওঁরা যদি সাহায্য চান, তবে প্রশাসনের তরফে সব রকম সাহায্য করা হবে।’’

Advertisement

আর্থিক ভাবে দুর্বল শেরশাবাদিয়া সমাজের মহিলাদের মধ্যে প্রায় ঘরে ঘরে এই কাঁথা সেলাইয়ের প্রচলন রয়েছে। চাঁচলের খানপুর, গোয়ালপাড়া, রামপুর থেকে শুরু করে হরিশ্চন্দ্রপুর ও রতুয়ার বিভিন্ন এলাকায় গেলেই চোখে পড়বে বাড়ির সামনে কাঁথা সেলাই করছেন মহিলারা। নিজেদের বিছানার চাদর বা তোশক কেনার সামর্থ্য নেই বলে পুরনো ব্যবহৃত কাপড় দিয়ে কাঁথা তাঁরা সেলাই করেন। উপহার কেনারও সামর্থ্য না থাকায় ওই কাঁথা হাতেই বিয়ে বা যে কোনও অনুষ্ঠানেও হাজির হন অনেকে। পুরনো কাপড় ও সুতো ব্যবহার করায় শ্রম বাদ দিয়ে খুব বেশি খরচ নেই। কিন্তু এই ব্যবহারিক প্রয়োজনে নকশি-কাঁথা সেলাই করতে গিয়েই ক্রমশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন তাঁরা। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে ওই মহিলাদের অধিকাংশই ক্রেতার রুচিমতো নকশি-কাঁথা তৈরি করে দিতে পারেন অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্যে।

সাজুর মতোই প্রেম, বিয়ে, বিরহের ছবি নকশি-কাঁথায় ফুটিয়ে তোলেন তাঁরা। নিপুণ হাতে ফুটে ওঠে সুতোয় আঁকা নানা রঙের ফুল, পাইকর পাতা, খেজুর পাতা-সহ রকমারি ছবি। ঘন সেলাইয়ের বুনোটে তৈরি তিন থেকে চার কেজি ওজনের এ রকম একেকটি কাঁথার দাম এক থেকে দেড় হাজার টাকা।

হরিশ্চন্দ্রপুরের একটি স্কুলের কর্মশিক্ষা ও অঙ্কনের শিক্ষিকা আলপনা দাস বলেন, ‘‘রঙ-বেরঙের নকশি কাঁথাগুলি দেখলেই বোঝা যায় যে দক্ষ ও নিপুণ হাতে তৈরি। আধুনিকতার ছোঁয়া মেশালে তা আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠবে।’’ খানপুরের রাহেলা বিবি, সারিয়া খাতুনরা বলেন, ‘‘এখন কেউ বললে কাঁথা তৈরি করে দিই। আমাদের অনেকের সুতো কেনারও সামর্থ নেই। সাহায্য পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম।’’

বাংলাদেশ থেকে নকশি কাঁথা বিদেশে রফতানি হলেও মালদহের এই কাঁথার প্রচলন এখনও স্থানীয় ভাবেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। শেরশাবাদিয়া সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই কাজ করছে খানপুর আজাদ গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা। এলাকার নকশি কাঁথার শিল্পীদের নিয়ে স্বনির্ভর দল গড়তে উদ্যোগী হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। কেন্দ্রীয় বস্ত্র মন্ত্রকের আম্বেদকর হস্তশিল্প বিকাশ যোজনা প্রকল্পে বাঁশ ও মৃৎ শিল্পীদের স্বনির্ভর করতেও দল গড়ে কাজ করছে সংস্থাটি। সংস্থার সম্পাদক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘‘নকশি কাঁথার শিল্পীদের নিয়ে দল গড়ে তাদের যাঁতে প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, সেই উদ্যোগ নিচ্ছি। কিন্তু আমাদের কাজের পরিধি সীমিত। প্রশাসন এগিয়ে না আসলে সার্বিক ভাবে কিছু করা সম্ভব নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন