পিক-আপ ভ্যানে ধাক্কা স্কুলবাসের

ক্রমাগত কাঁপতে থাকা খুদে হাতদু’টোকে শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন এক মহিলা। প্রতিবার নিশ্বাস নেওয়ার সময় শরীরটাও কেঁপে উঠছিল নীল রঙের ইউনিফর্ম পরা ছাত্রীটির।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০৩:৪২
Share:

বাস আটকে বিক্ষোভ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক

ক্রমাগত কাঁপতে থাকা খুদে হাতদু’টোকে শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন এক মহিলা। প্রতিবার নিশ্বাস নেওয়ার সময় শরীরটাও কেঁপে উঠছিল নীল রঙের ইউনিফর্ম পরা ছাত্রীটির। ফুলে ওঠা লালচে চোখে জল নেই, কিন্তু আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। মধ্যবয়সী মহিলা বারেবারে ছাত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ভয়ের কিছু নেই। তবু স্বাভাবিক হতে পারছিল না সদ্য বাস দুর্ঘটনার মুখোমুখি হওয়া ছাত্রীটি।

Advertisement

মঙ্গলবার সকালে শিলিগুড়ির চম্পাসারি অঞ্চল লাগোয়া এলাকা। একটি স্কুলবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে একটি পিকআপ ভ্যানকে। স্কুলবাসের চালক মদ্যপ ছিল বলে অভিযোগ। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে যাওয়ার সময় সামনে একটি পিকআপ ভ্যান দেখে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষলেও শেষরক্ষা হয়নি। বিকট ঝাঁকুনি দিয়ে বাসটি পিকআপ ভ্যানে ধাক্কা মারে। বাসে থাকা পড়ুয়াদের অনেকেই সিট থেকে ছিটকে পড়ে। ছাত্রীটিও সিট থেকে বাসের মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। চোট গুরুতর না হলেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল বাসে থাকা পড়ুয়ারা। ঘটনার পরে বাসিন্দারা পড়ুয়াদের বাস থেকে নামিয়ে অন্য একটি বাসে চাপিয়ে সেবক রোডের স্কুলে পাঠায়।

ঘটনায় হতচকিত কোনও পড়ুয়া দীর্ঘক্ষণ ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছে। কারও বা আতঙ্কে কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কোনও পড়ুয়া আবার ছুটির পরে অভিভাবকদের সঙ্গে রিকশায় চাপতেও ভয় পেয়েছে। চম্পাসারি এলাকার এক বাসিন্দার দাবি, ষষ্ঠ শ্রেণির এক পড়ুয়াকে বারবার কোথাও লেগেছে কিনা জানতে চাইলেও কোনও উত্তর দেয়নি সে। ঝাঁকুনিতে বাসের হাতলে মাথা ঠুকে গিয়েছিল ওই পড়ুয়ার। এলাকার বাসিন্দা কল্পনা মণ্ডল বলেন, ‘‘সকলেই প্রচন্ড আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। বাসের ব্রেক কষার বিকট শব্দ শুনে আমরাই চমকে উঠেছিলাম, আর ওরা তো বাসের ভিতরে ছিল। কারও চোট বেশি ছিল না ঠিকই, কিন্তু ওদের মনের ওপর খুব চাপ পড়েছে।’’

Advertisement

সেবক রোডের ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেছে, পড়ুয়ারা সকলেই শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ রয়েছে। যারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল, তাদেরও স্কুলে বুঝিয়ে স্বাভাবিক করা হয়েছে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বাসটিকে এ দিন আর চালায়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ। বাড়িতে ফোন করে ছুটির সময়ে অভিভাবকদের স্কুলে ডেকে পাঠায় কর্তৃপক্ষ। তবে দুর্ঘটনার স্মৃতি বারবার উসকে ওঠায় এক পড়ুয়া বায়না করে সে হেঁটেই বাড়ি ফিরবে। চম্পাসারির নর্মদা বাগানের বাসিন্দা ওই পড়ুয়াকে স্কুটারে চাপিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলেন তার অভিভাবক। আতঙ্কিত পড়ুয়া কিছুতেই স্কুটারে উঠতে চায়নি। অভিভাবকের কথায়, ‘‘স্কুটার, রিকশা কিছুতেই উঠতেই চাইছিল না। শুধু বলছিল, আবার ধাক্কা লাগবে। অনেক বুঝিয়ে শেষে রাজি করাতে পেরেছি। এমন চললে তো মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।’’

এ দিনের ঘটনা ফের কাঠগোড়ায় তুলে দিয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাকে। স্কুলবাসের চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ করতে হবে তাও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় উল্লেখ রয়েছে। চালকদের উর্দি পড়া এবং তাঁদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা থাকলেও তা হয় না বলে অভিযোগ। চালকের বিরুদ্ধে কোনও ট্রাফিক আইন ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে কিনা, তাঁর ন্যূনতম পাঁচ বছর বাস চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা তাও শিলিগুড়িতে যাচাই করা হয় না বলে অভিযোগ। তার জেরেই অনায়াসে মদ্যপ অবস্থাতেই চালক পড়ুয়া ঠাসা স্কুল বাস নিয়ে রাস্তায় বের হতে পারে বলে দাবি।

পুলিশ জানিয়েছে, এ দিন ধৃত চালকের বিরুদ্ধে এর আগে ট্রাফিক আইন ভাঙার অভিযোগ রয়েছে কিনা, অথবা তার ড্রাইভিং লাইসেন্স যথাযথ রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্কুলবাসের চালকের নাম-ঠিকানা সহ বিভিন্ন বিবরণ পুলিশ প্রশাসনের কাছে জমা রাখার নিয়ম থাকলেও, স্কুল কর্তৃপক্ষ তা করেনি বলে অভিযোগ। এমনকী ওই স্কুলের অন্য বাসগুলিও কারা চালায় তার তথ্য জানা নেই বলে পুলিশের দাবি। যদিও, স্কুলের এক অভিভাবকের কটাক্ষ, ‘‘দুর্ঘটনার পরে হুঁশ ফিরে আর কী হবে। আগে থেকে প্রশাসন তৎপর হলে আমার মেয়েটাকে এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হত না।’’

প্রশ্ন উঠেছে শহরে চলাচলকারী অন্য বাসগুলি নিয়েও। যদিও শহরের স্কুলবাস মালিকদের সংগঠনের সম্পাদক শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করে বলেন, ‘‘বাস চালকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যাতে যথাযথ নিয়ম মানা হয়, এবং চালকদের সুস্থতার ওপরে নিয়মিত নজর রাখা হয় তার জন্য সব সংস্থাকে সর্তক করা হয়েছে।’’ বাস্তবে সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে কিনা তা দেখতে চলতি সপ্তাহ থেকেই অভিযান শুরু হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন