প্রতিমার আড়ালে রয়েছে প্রাচীন জনপদের ইতিহাস

ময়নাগুড়ির থানা রোডে রয়েছে ময়নামাতার মন্দির। ময়নামাতাই এখানে কালী রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন, আঞ্চলিক উচ্চারণে যা ‘মইনামাতা’—যার ইতিহাস এবং কিংবদন্তির কথা ও কাহিনিকে আশ্রয় করে আস্ত একটা জনপদের নাম হয় মইনাগুড়ি, অপভ্রংশ ময়নাগুড়ি।

Advertisement

অনিতা দত্ত

ময়নাগুড়ি শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৪৫
Share:

থানা রোডে ময়নামাতার মন্দির।

ময়নাগুড়ির থানা রোডে রয়েছে ময়নামাতার মন্দির। ময়নামাতাই এখানে কালী রূপে পূজিতা হয়ে আসছেন, আঞ্চলিক উচ্চারণে যা ‘মইনামাতা’—যার ইতিহাস এবং কিংবদন্তির কথা ও কাহিনিকে আশ্রয় করে আস্ত একটা জনপদের নাম হয় মইনাগুড়ি, অপভ্রংশ ময়নাগুড়ি।

Advertisement

কে এই ময়নামাতা? অসমের ঐতিহাসিক রাজমোহন নাথের ‘কোদলী রাজ্য’ গ্রন্থটি বলছে: সপ্তম, অষ্টম শতকে রাজ্য ও রাজধানী হিসাবে পরিচিত ছিল এই ময়নাগুড়ি। কামরূপের পাল বংশের রাজা ধর্মপালের বোন ময়নামতী। তিস্তা নদীর পারে ভ্রাতা ও ভগিনী উভয়ের বাহিনীর যুদ্ধ বাধে। যে যুদ্ধে বোনের কাছে পরাজিত হন ধর্মপাল। যদিও কারও কারও দৃঢ় বিশ্বাস, ময়নামতী আদতে এক কোচ রমণী, যিনি ছিলেন এক সামন্ত প্রভু বা সাম্রাজ্ঞী। বিয়ের পর যাঁর পরিচয় হয় ‘মইনামাতা’ নামে। কারও মতে, এই মইনামাতা আসলে এক গ্রামদেবতা, যাঁর বাহন বাঘ। ময়নাগুড়ির রেলগেট সংলগ্ন খাগড়াবাড়ি গ্রামে এবং পানবাড়ির উত্তর দিকের কাউয়াকাব এলাকায় মইনামাতা আজও গ্রামদেবী রূপেই পূজা পান।

লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক দীপক রায় জানান, ইতিহাস ও কিংবদন্তি বলে, মইনামাতা একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, যিনি পরবর্তী কালে গ্রামদেবীতে রূপান্তরিত হন। বর্তমানে যেখানে ময়নামাতার মন্দির, এক সময়ে গ্রামদেবতার স্থান ছিল সেখানে। পরবর্তী কালে মইনামাতাকে কালীরূপে চিহ্নিত করা হয়।

Advertisement

বিশ শতকের গোড়ায় স্থানীয় তহসিলদার রাধিকানাথ নন্দীর উদ্যোগে বর্তমান মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়। পবনচন্দ্র দাস, ভোলানাথ মল্লিক, হেমচন্দ্র দাসের দান করা জমিতে মন্দিরটি গড়ে ওঠে।

কাশী থেকে ন’ ইঞ্চি লম্বা সোনার কালী প্রতিমা নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্দিরে। নব্বইয়ের দশকে চুরি হয়ে যায় মূর্তিটি। বর্তমানে কালো কষ্টি পাথরের কালী মূর্তিটিই পূজিত হয়ে আসছে।

ময়নামাতার সঙ্গে মিশে আছে তন্ত্র সাধনার ধারা। বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়াদের যে ধর্মীয় পরম্পরা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নাথ ধর্ম। এই নাথ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে ময়নামতী গোপীচন্দ্রের গান। এই গীতকথা এই অঞ্চলে আজও প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত গীতকথায় রানি ময়নামতীর সঙ্গে ভুটানিদের যুদ্ধের কথা শোনা যায়। মইনাগুড়ি নামের উল্লেখ রয়েছে ১৯৯৫-এর ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স সেটেলমেন্ট রিপোর্টেও। কালিকাপুরাণ অনুযায়ী চারটি পীঠের একটি রত্নপীঠ।

কোচবিহার ও রংপুরের মতোই জলপাইগুড়িও রত্নপীঠ অঞ্চল। একসময় বৌদ্ধ তান্ত্রিকরা লাসা থেকে নেমে এসে সিল্ক রুট ধরে চামুর্টি, ময়নাগুড়ি হয়ে রংপুর ভোটপন্টি কিংবা বাঁ দিকে কামাখ্যায় যাতায়াত করতেন। ময়নাগুড়ি ছিল তান্ত্রিক ধর্মের পীঠস্থান। ইতিহাসবিদ আনন্দগোপাল ঘোষের মতে, ময়নামতী তান্ত্রিক ধর্মের দেবী। এই অঞ্চলে তন্ত্রের প্রভাব ছিল। প্রতিষ্ঠিত কোনও ধর্ম সেই সময় এখানে ছিল না। তান্ত্রিক ধর্ম হিন্দু মঙ্গোলিয়ান জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। জনবিরল পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চলে সেই ধর্মচর্চা হত। ময়নামাতাকে তন্ত্রের দেবী বলাই যুক্তযুক্ত বলে তিনি মনে করেন।

মন্দিরে নিত্য পূজার ব্যবস্থা রয়েছে। চতুর্দশী অমাবস্যাতে জাঁকজমক সহকারে পুজো করা হয়।

কালী প্রতিমার আড়ালে ঢাকা রয়েছে তার আঞ্চলিক রূপ। ইতিহাস ও কিংবদন্তীর ছত্রচ্ছায়ায় খুঁজে পাওয়া যায় আঞ্চলিক ধর্মবিশ্বাস। আর এখানে কালী রূপে পূজিত হয়ে আসছে এই দেবী ময়নামাতা।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন