(বাঁ দিক থেকে) নিয়োগী পরিবারের পুজোয় সাবেক প্রতিমা। আগে প্রকাশিত হতো ‘ঘরোয়া’ পত্রিকা। এখন সেটি বেরোয় ‘জ্যোতি’ নামে। —নিজস্ব চিত্র।
আড়ম্বরের পুজো নয়। টিকে আছে আজও আবেগ ও নিষ্ঠায় ভর দিয়েই। পারিবারিক পুজোগুলি শহর জলপাইগুড়ির ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে আজও। পুজোগুলি অঞ্জলি, ধুনুচি নাচ, আড্ডা, এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, এককথায় প্রবাসী আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হবার ক্ষেত্রও বটে। পাশাপাশি এই পুজোকে কেন্দ্র করেই কোনও বাড়িতে পত্রিকা প্রকাশের ঢল রয়েছে তো কেউ পরিবারের সম্মিলিত উদ্যোগে পুজো প্রাঙ্গণ মাতিয়ে আসছে ভক্তিগীতি, মহাষাসুরমর্দিনী পালায়।
পাতায় পাতায় হাল্কা রঙের নানান ছবি, ছবির ওপরে হাতে-কলমেই লেখা হত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি। সেই পত্রিকার নাম ‘ঘরোয়া’। প্রকাশক জলপাইগুড়ির নিয়োগী বাড়ি। এক সময় পুজো উপলক্ষে নিয়োগী বাড়ির ছেলেমেয়েরাই বের করত হাতে লেখা এই পত্রিকা ‘ঘরোয়া’। এখন নাম হয়েছে ‘জ্যোতি’।
ফি বছর ষষ্ঠীর দিন বাড়িতে দেবীর বোধনের তোড়জোড়ের ফাঁকেই প্রকাশিত হয়ে আসছে। বাড়ির আট থেকে আশি সবাই এ পত্রিকায় লেখেন। পরিবারের প্রতিনিধি শ্যামশ্রী নিয়োগী জানান, শুধু এ বাড়ির বাসিন্দারাই নন, নিয়োগী বাড়ির আত্মীয়তার সূত্রে সবাই আবদ্ধ, লেখক তালিকায় রয়েছেন তাঁরাও।
এ বছর এ পুজো দু’শো আট বছরে পা দেবে। ১৯২১-এ ঢাকার পাটগ্রামে এ পুজোর প্রচলন হয়। এক চালার প্রতিমার ডান দিকে থাকেন কার্তিক, সরস্বতী, বাঁ দিকে গণেশ, লক্ষ্মী। গণেশের পাশে নয়, এ বাড়ির রীতি অনুযায়ী কলা বৌ থাকে কার্তিকের পাশে। মহালয়ার পরের দিনই বসে যায় ঘট। প্রথা মেনে সপ্তমী আর অষ্টমীর সন্ধি মুহূর্তে কালীপুজো করা হয়। পঞ্চমীতে মনসা পুজো। একসময় পাঁঠাবলির চল থাকলেও এখন আর সে প্রথা নেই। বলি দেওয়া হয় চালকুমড়ো আর কলাগাছের থোড় দিয়ে বানানো শত্রুর প্রতিকৃতি। শেলী, নবনীতা, প্রিয়াংকা, পামেলারাই পুজোর যাবতীয় দায়দায়িত্ব সামাল দেয়। এ বাড়ির পুজোয় ভোগ রান্না করা হয় না। পুজোর ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয় হাতে তৈরি নাড়ু, মোয়া, মিষ্টি। বিশেষ ভোগের তালিকায় রয়েছে লুচি ও ছানার পায়েস। সব মিলিয়ে নিয়োগী বাড়ির পুজো আজও স্বতন্ত্র।
ঐতিহ্যশালী পারিবারিক পুজোগুলির মধ্যে রয়েছে নতুনপাড়ার গুহ পরিবারের তিনশো বছরেরও বেশি পুরোনো পুজোটি। এ পুজোর প্রাণপুরুষ বারো ভুঁইয়ার বংশধর স্বর্গীয় রাজারাম গুহ। শুরু হয়েছিল যশোরের লস্করদিয়া গ্রামে। রীতি মেনে রথযাত্রার দিন শুরু হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। একচালার প্রতিমা দর্শন করতে আজও গ্রামের মানুষ ভিড় জমান। এখানে দেবির ডান দিকে থাকেন গণেশ লক্ষ্মী আর বাঁ দিকে কার্তিক ও সরস্বতী। নবমীর দিন বিশেষ ভোগ হিসেবে থাকে বোয়াল মাছ। একসময় এই পুজোয় বস্ত্র বিতরণ করা হত। বসত যাত্রার আসর, চলত কবিগান। সে সব এখন বন্ধ হয়ে গেলেও পুজো প্রাঙ্গণে বসে ভক্তিগীতির আসর। মহিষাসুরমর্দিনী পালায় অংশ নেন বাড়ির মেয়ে ও পুরুষ সকলেই। এ ভাবেই দেবী বন্দনার মধ্যে দিয়ে ঐতিহ্য ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।