নিজেদের সাম্মানিক জুটছে না প্রায় দু’বছর। উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতে সায় দেয় না মন। তবু পুজো এলে স্কুলের গরিব পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে, তাদের হাতে নতুন জামা তুলে দেওয়ার তাগিদে সাহায্যের থলি নিয়ে ওঁরা ঘুরে বেড়ান শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের আনন্দ মাখা মুখগুলি থেকে বছরের অন্য দিনগুলির জন্য রসদ খুঁজে নেন শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মীরা।
কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক অনুদান এবং শ্রম দফতরের তত্ত্বাবধানে চলা জলপাইগুড়ি জেলার ১৯টি শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়েই ছবিটা মোটের উপর এক। ৯৫ জন শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মী প্রায় দু’বছর ধরে সাম্মানিক ভাতা পাচ্ছেন না। টিউশন করে নিজেদের পেটের ভাতের বন্দোবস্ত করে, ওঁদের প্রত্যেকে কিন্তু বিদ্যালয় চালু রেখেছেন। এমন কী নিজেদের সংসারের অনটনের কথা ভুলে চেয়েচিন্তে নতুন জামাকাপড় জুটিয়ে উৎসবের মরসুমে পড়ুয়াদের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যস্ত অনেকেই।
যেমন, এ বারও শহরের এক শিক্ষিকাকে বলে স্কুলের ৫০ জন পড়ুয়ার জন্য নতুন জামা জোগাড় করেছেন জয়ন্তীপাড়া শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রতীম চৌধুরী। আজ, মঙ্গলবার ওই জামা পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। নতুন জামার খবর পেয়ে সোমবারই স্কুলে হাজির হয়েছিল বাবুল মোহান্ত, বিজয় দাস, অঞ্জলি রাউত, অমল রাউতের মতো কচিকাঁচারা। কখন জামা হাতে পাবে সেটাই বারবার মাস্টারমশাই-এর কাছে জানতে চেয়েছে খুশিতে আত্মহারা মুখগুলি। সোমবার প্রধান শিক্ষক বলেন,“এতটুকু খুশির জন্যই তো দৌড়ে বেড়াই।”
শহরের একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা বনানী মুখোপাধ্যায় এবারও এগিয়ে এসেছেন। ছোটদের নতুন জামার ব্যবস্থা করেছেন। বনানী দেবী বলেন,“সাম্মানিক না পেয়েও ওখানকার শিক্ষকরা কেমন করে স্কুল চালাচ্ছেন সেটা ভেবেই অবাক হয়ে যাই। আমার আর কতটুকু সাধ্য। যতটা ইচ্ছে করে পারি না। স্কুলের বাচ্চাদের হাসিটুকুই আমার প্রাপ্তি।”
কেন এভাবে ভাবেন বনানীদেবী? পড়ুয়াদের অভিভাবকরা কেউ সাফাই কর্মী, কেউ পরিচারিকা, কেউ আবার পেশায় রিকশা চালক। লেখাপড়া করা, পুজোয় নতুন জামা, এসবতো দূর অস্ত, দুবেলা পেটের ভাত জোটে না অনেকেরই। সোমবারেও আধপেটা খেয়েই স্কুলে এসেছিল তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া অমলের মতো আরও অনেকেই। এলাকায় ঘুরে ওঁদের স্কুলমুখী করেছেন প্রধান শিক্ষক। তাই টিউশনি করে সংসার চালাতে হলেও এই সমস্ত ছেলেমেয়েদের দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন না কিছুতেই। ক্লাসের পড়ুয়াদের দেখিয়ে প্রতীমবাবু বলেন, “ওঁরা অনেক আশা করে থাকে। ওঁদের বিশ্বাস আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করব। তাই মুখ ফেরাতে পারি না।”
একই বক্তব্য সুকান্তনগর তিস্তা স্পেশাল শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবির চক্রবর্তীর। তিনি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে অনুরোধ করে তাঁর স্কুলের ৫০ জন পড়ুয়ার জন্য নতুন জামার ব্যবস্থা করেছেন। সোমবার ওই জামা ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবিরবাবু বলেন,“ওঁদের খুশিতে নিজের কষ্ট ভুলে থাকতে চাই। ওঁরা আনন্দ করুক। মানুষের জন্য ভাবতে শিখুক। এটাই চাই।”