মালদহ আদালত চত্বরে মানিকচকে সালিশির ঘটনায় ধৃত তিন মহিলা। মঙ্গলবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
গত সেপ্টেম্বরেই ধূপগুড়িতে সালিশি সভায় এক নাবালিকাকে নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। তারপরের দিন ওই নাবালিকার দেহ উদ্ধার করা হয়। তা নিয়ে রাজ্য জুড়ে কম হইচই হয়নি। কিন্তু তারপরে সালিশি সভা বসিয়ে এক বধূর চুল কেটে নেওয়া হল। ওই বধূ ও যুবককে ৫১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। সেই টাকা না পেয়েই ‘শাস্তি’ হিসেবে দু’জনকে মারধর করা হয়। তারপরে মহিলার চুল কেটে গ্রামে ঘোরানো হয়েছে।
সোমবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে মালদহের মানিকচক থানার মথুরাপুর গ্রামপঞ্চায়েতের করমুটোলা গ্রামে। অভিযোগ, তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএমের নেতা-কর্মীদের একাংশের মদতেই ওই সালিশি বসেছিল। এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য তথা তৃণমূলের নেতার অনুগামী এক মহিলা কর্মী ওই সালিশিতে সামনের সারিতে ছিলেন বলেও অভিযোগ।
তিনিই কাঁচি নিয়ে বধূটির মাথার চুল কদমছাঁট করে কেটে গ্রামে ঘোরানোয় নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ। ঘটনাটিকে ঘিরে গ্রামে প্রবল উত্তেজনা ছড়ায়। লাগাতার নির্যাতনে তরুণ ও বধূটির মৃত্যুও হতে পারে বলে পুলিশ খবর পায়। পুলিশ গিয়ে ওই দু’জনকে উদ্ধার করে মানিকচক হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে দু’জনকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। বধূটির অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ এলাকার ৩ মহিলাকে গ্রেফতার করেছে। আরও কয়েকজনকে খুঁজছে। পুলিশ জানায়, ধৃতদের নাম ভারতী মন্ডল, সবিতা মন্ডল ও মাংনি মন্ডল। ভারতী এলাকার তৃণমূল গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য বাবলু চৌধুরীর অনুগামী বলে পরিচিত। মঙ্গলবার পুলিশ ধৃতদের মালদহ জেলা আদালতে হাজির করায়।
মাসখানেক আগে ইংরেজবাজার শহরের নরহাট্টাতেও এক বিধবা মহিলাকে ধর্ষণের চেষ্টায় ঘটনায় সালিশি করে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এই ঘটনায় ওই নির্যাতিতা মহিলার বাবা গুরুতর ভাবে জখম হয়েছিলেন। তাঁর ডান চোখে লোহার রড দিয়ে আঘাত করা হয়। এখনও তাঁর চোখের চিকিত্সা চলছে। জেলায় একের পর এক সালিশির ঘটনায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার মানিকচকের মথুরাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের করমুটোলার বাসিন্দা ওই মহিলা গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে অন্যত্র চলে যান। দু’জনেরই বয়স ২৮ বছর। ওই মহিলার স্বামী পেশায় ভিন রাজ্যের দিনমজুর। তিনি সেই ঘটনায় থানায় অভিযোগ জানাননি। সোমবার দুপুরে ওই যুবক ও বধূটি গ্রামে ফেরেন। দু’জনে বিয়ে করবেন বলে দুই পরিবারের লোকজনদের জানিয়ে দেন। তা নিয়ে দুই পরিবারের কোনও আপত্তি ছিল না। এলাকার মহিলাদের একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীও দু’জনের সম্পর্ক মেনে নিতে সকলকে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু গ্রামের একদল মাতব্বর বেঁকে বসেন। তখনই সালিশি সভা বসে। ওই সভায় নেতৃত্ব দেন কয়েকজন মহিলা। তাঁরা ওই দু’জনের কাছ থেকে ৫১ হাজার টাকা জরিমানা বাবদ চান। টাকা না দিলে গ্রাম ছাড়া করা হবে বলে হুমকি দেন বলে অভিযোগ।
কিন্তু ওই বধূ ও যুবক জানিয়ে দেন, তাঁরা দু’জনে ভালবেসে ‘বিয়ে’ করবেন। তা হলে কেন জরিমানা দিতে হবে সেই প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। এর পরেই ওই বধূ ও যুবককে বেধড়ক মারধর করা হয়। বধূর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। ঘটনাটি চাউর হতেই মানিকচক থানার পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। এই ঘটনায় ১০ জনের নামে ওই মহিলা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। পুলিশ তিন জনকে গ্রেফতার করেছে।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই বধূর বিয়ে হয় ৮ বছর আগে। তাঁর বাপের বাড়ি রতুয়ায়। তাঁর ৬ বছরের একটি ছেলে রয়েছে। তাঁর শ্বশুরবাড়ির তিনটি বাড়ি পরেই থাকেন ওই যুবক। তিনিও শ্রমিকের কাজ করেন। বধূটির অভিযোগ, “আমি ওই যুবককে ভালবেসেছি। তাই আমাদের গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না বলা হচ্ছে। দুজন বিয়ে করব বলেছি। তার পরেও আমাদের মারধর করা হয়। আমার মাথার চুল কেটে দেন ওঁরা। আমরা থানায় অভিযোগ দায়ের করেছি।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে,ওই মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতে ৩৪১, ৩২৩ ও ৩২৫ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। মানিকচক থানার ওসি সঞ্জয় ঘোষ বলেন, “তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজে তল্লাশি শুরু হয়েছে।”
ধৃত ভারতী দেবী তৃণমূলের গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য বাবলু চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। বাবলুবাবু বলেন, “ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। আমি থাকলে এমন ঘটনা ঘটতে দিতাম না। আর এখানে দলের কোনও বিষয় নেই। গ্রামের মানুষেরা এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।” মানিকচকের কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি অভিজিত্ মিশ্র বলেন, “এমন ঘটনা কখনওই কাম্য নয়। সালিশি সভায় আমাদের দলের কেউ ছিল কি না, তা খোঁজ নিয়ে দেখব।” সিপিএমের লোকাল কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক শ্যামল দাসের দাবি, “আমি সব শুনেছি। তবে এখানে আমাদের দলের কেউ ছিলেন না।”