সহকারী ম্যানেজার খুন হয়ে যাওয়ার পরে বন্ধ দলমোড় চা বাগান।
দোলের আগে সপ্তাহখানেকের জন্য চার বছরের ছেলে বাপ্পুকে নিয়ে দলমোড় চা বাগানে ঘুরে গিয়েছিলেন সীমা পানোয়ার। রং খেলার বেশ কয়েকদিন বেশ আনন্দেই কেটেছিল পানোয়ার পরিবারের। ছেলেও রঙ খেলায় মেতে ওঠে। মাত্র কয়ে ক দিন আগের সেই আনন্দের রেশ নিয়েই তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন। বৃহস্পতিবার স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরের শ্বশুরবাড়িতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সীমাদেবী।
এ দিন দুপুরে দলমোড় চা বাগানের সহকারী ম্যানেজার অজিত পানোয়ারকে খুন করার অভিযোগ ওঠে বাগানেরই এক শ্রমিকের বিরুদ্ধে। দুপুর বেলা বাগানের ম্যানেজার ফোন করে উত্তরপ্রদেশের তাঁর বাড়িতে খবর দিতে গোটা বাড়ি জুড়ে শোকের পরিবেশ নেমে আসে। অজিতবাবুর বৃদ্ধ বাবা-মাও পুরোপুরি ভেঙে পড়েন। পাড়া পড়শিরাও তাঁদের বাড়িতে ভিড় করেন বলে জানা গিয়েছে।
সাত বছর আগে উত্তরপ্রদেশ থেকে স্নাতক হওয়ার পর অজিত পানোয়ার কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গে আসেন। কর্মস্থলের আশেপাশে আত্মীয় বলতে তরাইয়ের লোহাগড় চা বাগানের ম্যানেজার সুনীল পানোয়ার হলেন তাঁর খুড়তুতো দাদা। তাঁরই হাত ধরে তরাইয়ের একটি চা বাগানে সহকারী ম্যানেজারের পদে কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তরাই ডুয়ার্স মিলিয়ে তিনটি চা বাগানে কাজ করার পর বছর দু’য়েক ধরে দলমোড় চা বাগানে কাজ করছেন তিনি। শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ ছিল না বলেই কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে।
প্রায় পাঁচ বছর আগে আগে সীমাদেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পরে বৃদ্ধ মা বাবার দেখভালের জন্য সীমাদেবী উত্তরপ্রদেশ চলে যান। দম্পতির এক সন্তান বাপ্পু বাবার সঙ্গে শেষ সাত দিন খুব আনন্দেই কাটিয়েছিল। আত্মীয় সুনীলবাবু জানান, “গত তিন দিন আগেই ভাইয়ের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। বাগানে কোনও সমস্যা নেই বলে ও জানিয়েছিল। এর মধ্যে যে তাঁকে খুন হতে হবে তা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।” গলার সুর জড়িয়ে আসে তাঁর। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ দিন ময়নাতদন্ত হয়েছে। আজ শুক্রবার অজিতবাবুর দেহ উত্তরপ্রদেশে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে।
এ দিকে, দশ মাস বন্ধ থাকার পরে, বাগান খোলার পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের মত বিরোধের কথা শোনা যায়নি। বাগান বন্ধ থাকার দিনগুলি যাতে ফিরে না আসে, তার জন্য বাড়তি কাজও করে দিতেন অনেকেই। শ্রমিক মালিক বিবাদের জেরে বাগান বন্ধ হওয়ার পরে খুলতে দশ মাস লেগেছিল। বাগানের এক শ্রমিকের হাতে সহকারী ম্যানেজারের খুনের অভিযোগ ওঠায় বাগানের স্বাভাবিক কাজকর্ম চলবে কি না তা নিয়েই আতঙ্কে ভুগছেন শ্রমিকরা। বাগানের ম্যানেজার অজয় সিংহও এ বিষয়ে কিছু জানাননি।
বাগানের শ্রমিক মার্গারেট ওঁরাও রিজিলা ওঁরাও দের কথায়, “যখন বাগান বন্ধ ছিল সে সময় সময় আমরা কী দিন কাটিয়েছি তা একমাত্র আমরাই জানি। অনাহার, অর্ধাহারের দিন ভাবলেই আতঙ্ক হয়।” চা বাগান মালিক সংগঠন ডুয়ার্স ব্রাঞ্চ অব ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের উপ সচিব সঞ্জয় বাগচি বলেন, “এ ধরনের ঘটনার যত নিন্দা করা যায় তা কম। বাকি বাগান গুলির ম্যানেজাররা আতঙ্কে রয়েছেন।” ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখ্য উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তীর কথায়, “শ্রমিকদের কিছু বললে যদি ম্যানেজারকে খুন হতে হয় সে আতঙ্ক সকলের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে।”
কংগ্রেসের চা শ্রমিক সংগঠন এন ইউ পি ডব্লুর নেতা মনি ডারনাল বলেন, “এ ধরণের ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন যাতে দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করে তা দেখতে হবে। বাগানে যাতে পুনরায় এ ঘটনা না ঘটে এবং সকলে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখে তা আমরা শ্রমিকদের বলছি।” আরএসপি দলের চা শ্রমিক নেতা গোপাল প্রধানের কথায়, “তবে তার জন্য যাতে বাগান বন্ধ না হয় তা কর্তৃপক্ষকে বলা হবে। বাকি বাগানের শ্রমিকদের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা বলব”
ছবি: রাজকুমার মোদক।