বেদখল ফুটপাথ, নাজেহাল বাসিন্দারা

বিছানার গদি, পাইপ, রঙের টিন, ত্রিপল, শৌচাগারের নানা যন্ত্রাংশ, ত্রিপল, চেয়ার-টেবিল-আরও কত কিছু। সবই রাখা হয়েছে ফুটপাথে। সেবক মোড় থেকে পানিট্যাঙ্কি মোড় যদি যাতায়াত করতে চান, তা হলে প্রতি পদে ওই বিপুল পণ্য সম্ভার বাঁচিয়ে চলতে হবে। কারণ, ওই রাস্তায় দোকানের ভেতরে যত জায়গাই থাকুক না কেন, বাইরে মালপত্র রেখে ফুটপাথ দখল করাই যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ আমজনতার। ফলে, প্রতি পদে দুর্ভোগ চলছেই।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৫১
Share:

ফুটপাত ব্যবসায়ীদের দখলে। বসিন্দাদের চলতে হয় রাস্তা দিয়েই। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

বিছানার গদি, পাইপ, রঙের টিন, ত্রিপল, শৌচাগারের নানা যন্ত্রাংশ, ত্রিপল, চেয়ার-টেবিল-আরও কত কিছু। সবই রাখা হয়েছে ফুটপাথে। সেবক মোড় থেকে পানিট্যাঙ্কি মোড় যদি যাতায়াত করতে চান, তা হলে প্রতি পদে ওই বিপুল পণ্য সম্ভার বাঁচিয়ে চলতে হবে। কারণ, ওই রাস্তায় দোকানের ভেতরে যত জায়গাই থাকুক না কেন, বাইরে মালপত্র রেখে ফুটপাথ দখল করাই যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ আমজনতার। ফলে, প্রতি পদে দুর্ভোগ চলছেই।

Advertisement

সেই ভোগান্তি আরও বাড়াচ্ছে ফুটপাথ ঘেঁষে জবরদস্তি দাঁড় করিয়ে রাখা অসংখ্য রিকশা-ভ্যান, বাইক, গাড়ি। পাশেই রাখা হয় গাড়ি। যে গাড়িগুলির একটা বড় অংশ সেবক রোডের ব্যবসায়ীদেরই। দোকানের সামনের জায়গা জুড়ে মালিকদের গাড়ি থাকবে, এটাই যেন বিধি। তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে কিংবা প্রতিবাদ করতে চাইলে পুলিশ-প্রশাসন-পুরসভার সমর্থন যে মিলবে সেই নিশ্চয়তা নেই। ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের অভিযোগ, অলিখিত একটা বোঝাপড়ার সুবাদে পুরসভা-পুলিশ-প্রশাসন যেন এক সূত্রে বাঁধা পড়ে রয়েছে। ফলে, শহরে অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গেলে প্রতি পদে হয়রানির মুখে পড়ার আশঙ্কা।

বস্তুত, ফুটপাত আর রাস্তা দখল করে যে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্র রাখেন, তাঁদের সঙ্গে এক শ্রেণির নেতা ও প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশের সম্পর্ক কতটা ‘গভীর’ তা মাঝেমধ্যে সামনেও এসেছে। যেমন, বিধান মার্কেটের কথাই ধরা যাক। যে কোন দিন ভোরে কিংবা গভীর রাতে বিধান মার্কেটে ঢুকলে দেখা যায়, প্রতিটি দোকানের সামনে কতটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। রাস্তা কতটা চওড়া সেটাও স্পষ্ট হয়। কিন্তু, বেলা ১০টা বাজলেই বিধান মার্কেটের ভিতরে বেশির ভাগ রাস্তার সিংহভাগ দখল হয়ে যায়। কোথাও বাসনকোসন সাজানো থাকে। কোথাও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাস্তার ধারের ২-৩ ফুট দখল করে রাখেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী। বিধান মার্কেটের প্রতিটি গলিতে একই দৃশ্য। দোকানের সামনে রাস্তার কিছুটা জায়গা জুড়ে থরে থরে পণ্য সাজানো। একই ছবি জর্জ মর্বাট রোডে। রাস্তার অনেকটা জুড়ে রাখা থাকে লোহালক্কর, তারজালি, গামলা, বালতি-সহ নানা সরঞ্জাম।

Advertisement

এভাবে দোকানের সামনে রাস্তা দখল চলতে পারে নাএমনই সদর্থক একটা ভাবনায় শিলিগুড়ি পুরসভার তরফে বছর তিনেক আগে মাইকে প্রচার করা হয়। পুরসভার পক্ষ থেকে লিফলেট ছড়িয়ে বিধান মার্কেটের ব্যবসায়ীদের রাস্তায় পণ্য না রাখার অনুরোধও করা হয়। তাতে কাজ হয়নি। তখন পুরসভা অভিযান চালিয়ে বিধান মার্কেটে গিয়ে ওইসব পণ্য সরিয়ে রাস্তা দখলমুক্ত করে। দুপুর নাগাদ পুরসভার অভিযান হয়। পুরসভার লোকজন চলে যাওয়ার পরে ফের রাস্তায় জিনিসপত্র সাজিয়ে ফেলতে ওই ব্যবসায়ীদের সময় লেগেছিল বড় জোর আধ ঘণ্টা। ব্যবসায়ীদের একাংশ একান্তে দাবি করেছেন, সে দিন অভিযান শুরুর আগে একজন জনপ্রতিনিধি তথা শাসক দলের নেতা সবাইকে আশ্বাস দিয়ে জানিয়েছিলেন, পুরসভার লোকজন চলে গেলে ফের জিনিসপত্র সাজানো যাবে। বিধান মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির একাধিক কর্তা জানিয়েছেন, রাস্তার দুধারে জিনিসপত্র রাখার প্রবণতা বন্ধ করতে না পারলে আগামী দিনে বিধান মার্কেটে দিনভর যানজট হবে। ফলে, ব্যবসাও মার খাবে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

সেবক রোডে অবশ্য ব্যবসা মার খাওয়ার আশঙ্কা তেমন নেই। কারণ, বাম আমলে সেবক রোড অনেকটাই চওড়া হয়েছে। তাই রাস্তায় আগের তুলনায় বেশি জিনিসপত্রও রাখতে পারছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। সেবক রোড থেকে চার্চ রোডে গেলেও দেখা যায় রাস্তা দখলের প্রতিযোগিতা চলছে যেন। পানিট্যাঙ্কি মোড়, গুরুদ্বারের আশেপাশেও একই দৃশ্য। ওই রাস্তার নিত্যযাত্রীরা অনেকেই বলেছেন, ‘পুরসভা যদি জরিমানা চালু করতে পারত তা হলে রাস্তা দখলের প্রবণতা কমত। আমরাও নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারতাম।’ যে ব্যবসায়ীরা ফুটপাথে সরঞ্জাম রাখেন। রাস্তার ধারে গাড়ি রাখেন। দোকানের চুক্তি ভিত্তিক ভ্যান-রিকশা জুড়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন, তাঁদের কি যাতায়াতে সমস্যা হয় না? সেবক রোডের ব্যবসায়ী তথা শিলিগুড়ি হার্ডওয়ার মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি প্রদ্যুম্ন সিংহ চহ্বান বলেন, “সকলেই যে রাস্তায় জিনিসপত্র রাখেন তা নয়। কেউ কেউ রাখেন। তাতে আমাদেরও অসুবিধে হয় বৈকি। তবে সেবক রোডে কোনটা ফুটপাথ আর কোনটা দোকানের নিজস্ব জায়গা সেটা স্পষ্ট নয়। পুরসভা-প্রশাসন ফুটপাথ চিহ্নিত করে দখল মুক্ত রাখাটা নিশ্চিত করুক। আমরা সহযোগিতা করব। কিন্তু, যথেচ্ছ কেউ হকার বসিয়ে দেবেন তা হতে পারে না। ফুটপাথ-নীতি স্পষ্ট করা হোক।”

শহরে ফুটপাথ-নীতি থাকাটা যে জরুরি তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই সংশয় নেই। তাঁদের মতে, লন্ডনের মতো শহরে ফুটপাথে হাঁটার অধিকার রক্ষার্থে পৃথক আইন রয়েছে। ‘রাইট অব ওয়ে’ নামের আইন অনুযায়ী হাঁটার রাস্তায় কেউ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারবেন না। দুনিয়ার অনেক শহরেই নাগরিকদের হাঁটার জন্য ফুটপাথ দখল মুক্ত রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা অতি মাত্রায় তত্‌পর। কিন্তু, শিলিগুড়িতে নাগরিকদের চলাফেরার রাস্তায় আস্ত একটা বাণিজ্যিক ভবন তৈরির অনুমতি দিয়েছে পুরসভা ও শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ)। ফুটপাত অদৃশ্য করে শপিং কমপ্লেক্স গড়ার ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে জোট বাঁধছে গোটা শহর।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন