সুবাস ঘিসিঙ্গ। —ফাইল চিত্র।
রাজনৈতিক জীবনে বরাবরই বিরোধীদের সঙ্গে ‘অম্ল-মধুর’ সম্পর্ক ছিল সুবাস ঘিসিঙ্গের। কোনও সময় লোকসভা ভোট বয়কট করে ঘুরিয়ে শাসক বামফ্রন্টের পাশে দাঁড়াতেন। আবার কোনও সময় সরাসরি কংগ্রেস প্রার্থীকে লোকসভায় জেতাতে ময়দানে নেমে পড়তেন। দীর্ঘদিন পাহাড়ের তিন বিধানসভার রাশ নিজের হাতে রেখেছিলেন। শেষে তা আলগা হতে আবার তৃণমূলের পাশেও তাঁকে দাঁড়াতে দেখা যায়। এই বিচিত্র রঙিন রাজনৈতিক চরিত্রের মৃত্যুতে অবশ্য পাহাড়, সমতলের সব দলই এখন একই সারিতে। সেখানে যেমন রয়েছেন সিপিএম, কংগ্রেস বা সিপিআরএম নেতৃত্ব, তেমনই রয়েছেন গোর্খা লিগ ও পাহাড়ের বর্তমান শাসক, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতারা।
পাহাড়ের রাজনৈতিক দলের নেতারা অকপটে জানিয়ে দিয়েছেন, দার্জিলিঙের আলাদা রাজ্যের দাবি তোলা এবং তাকে ঘিরে আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ পুরুষ ছিলেন সুবাস ঘিসিঙ্গই। বাড়িঘর ছেড়ে পাহাড়ি গ্রামে গ্রামে ঘুরে আলাদা রাজ্যের স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়া আর বাসিন্দাদের বোঝানোর কাজ তাঁর মত কেউ করেননি। তাই একসময় টানা দুই দশক তিনিই ছিলেন পাহাড়ের ‘রাজা’। বয়সের ভার এবং নানা অসুস্থতা সত্ত্বেও শৈলশহরের গ্রামেগঞ্জে তৃণমূল স্তরের এখনকার খোঁজখবর রাখতেন তিনি। জিএনএলএফের উত্তরসূরি তেমনভাবে তৈরি না করলেও দলকে উঠে যেতে দেননি তিনি। তাই আজও পাহাড়ের আনাচে কানাচে জিএনএলএফের সবুজ পতাকা উড়তে দেখা যায়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁর মৃত্যুর খবর জেলার পৌঁছাতেই সব দলের তরফেই ওই নেতার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। সুবাস ঘিসিঙ্গের ছেলে মোহন ঘিসিঙ্গ দিল্লিতে ছিলেন। তিনি বলেন, “পাহাড়ের প্রতি বাবা’র টান এবং মানুষের ভালবাসা আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখছি। রাজনীতি করতেন ঠিকই, কিন্তু মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ করতেন না। তাই আজকের দিনে বিভিন্ন দল এবং নানা স্তরের মানুষ সমবেদনা জানাচ্ছেন।”
এদিন রাতে মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সুবাস ঘিসিঙ্গের মৃত্যু পাহাড়ের মানুষের জন্য বিরাট ক্ষতি। পাহাড়ের উন্নয়নে ওঁর অবদান প্রশংসনীয়। মানুষ তা মনে রাখবে। আমি ওঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে মোর্চা গঠনের আগে পর্যন্ত বিমল গুরুঙ্গ দীর্ঘদিন ঘিসিঙ্গের অন্যতম অনুগামী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। ‘গুরু-শিষ্যে’র তকমা দিয়ে পাহাড়ে দুই জনকে আজও মনে রাখা হয়।
রাজনৈতিক মতভেদ তৈরি হওয়ায় ঘিসিঙ্গের কাছ থেকে সরে এসেছিলেন নিহত গোর্খা নেতা মদন তামাঙ্গ। তৈরি করেছিলেন নতুন দল, গোর্খা লিগ। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ খাতি বলেন, “আলাদা রাজ্যের দাবি যে করা যায়, তা প্রথম যুক্তি দিয়ে সুবাস ঘিসিঙ্গই পাহাড়বাসীকে দেখিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন এখনও অধরা থেকে গিয়েছে। আজ গোর্খাদের বড় দুঃখের দিন।” কমিউনিস্ট দল সিপিআরএমের সঙ্গে বরাবর দূরত্ব বজায় রেখে চলতেন ঘিসিং। এদিন দলের মুখপাত্র গোবিন্দ ছেত্রী বলেন, “অতীতে কি হয়েছে তা এখন মনে করার দিন নয়। উনি আলাদা রাজ্যের জন্যই সব করেছেন। ওঁর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।”
বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা জানাচ্ছেন, রাজ্যের শাসক দলের সঙ্গে বরাবর ‘বোঝাপড়া’ করেই চলতেন ঘিসিঙ্গ। নানাভাবে বাম আমলের মত তৃণমূল আমলেও তা দেখা গিয়েছে। তা ভোটই হোক বা ত্রিপাক্ষিক বৈঠক। তবে নিজের অবস্থানে অনড় থেকে পাহাড়ের কাজ হাসিল করাতে জিএনএলএফ সুপ্রিমোর জুড়ি মেলা ছিল ভার। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা দার্জিলিং জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি গৌতম দেব বলেন, “আমাদের জেলার প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে উনি ছিলেন অন্যতম। ওঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোক প্রকাশ করছি। আজ, শুক্রবার আমি বিমানবন্দরে গিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাব।” তৃণমূলের পাহাড়ের নেতা বিন্নি শর্মা এক সময়ে সুবাস ঘিসিঙ্গকে কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি বললেন, “অন্য মাপের মানুষ ছিলেন উনি। পাহাড়ের রাজনীতিতে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়ে গেল।”
রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য আর তাঁর দলের জেলা সম্পাদক জীবেশ সরকার বলেছেন, “উনি পাহাড়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। উনি বাস্তববাদী ছিলেন, তাই প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পার্বত্য পরিষদ গড়েছিলেন। ওঁর মত রাজনৈতিক নেতার মৃত্যু জেলার একটি বড় ক্ষতি।”
জেলার কংগ্রেসের প্রার্থীদের কয়েক দফায় লোকসভায় পাঠানোর পিছনে ঘিসিঙ্গের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। এদিন দার্জিলিং জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বিধায়ক শঙ্কর মালাকার বলেছেন, “আমার সঙ্গে সুবাস ঘিসিঙ্গের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। আড়াই দশক ধরে ওঁকে দেখেছি পাহাড়ের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য উনি কীভাবে লড়াই করেছেন। আমরা গভীরভাবে শোকাহত।”