শিলিগুড়িতে হোটেলে আগুন

বেশিরভাগ হোটেলেই নেই বিকল্প রাস্তা, আগুন নেভানোর সুব্যবস্থা

শিলিগুড়ির কিছু হোটেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ নয়, কোথাও আপত্‌কালীন পরিস্থিতিতে বহুতল হোটেলে থাকা বাসিন্দাদের বার হওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হোটেলকর্মীদের বেশিরভাগই জানেন না, কী করে আগুন নেভানোর যন্ত্র ব্যবহার করবেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তা নেভাতে জলাধারের ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রেই নেই।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী ও সৌমিত্র কুন্ডু

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:২১
Share:

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হোটেল। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে (ইনসেটে)।

শিলিগুড়ির কিছু হোটেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ নয়, কোথাও আপত্‌কালীন পরিস্থিতিতে বহুতল হোটেলে থাকা বাসিন্দাদের বার হওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হোটেলকর্মীদের বেশিরভাগই জানেন না, কী করে আগুন নেভানোর যন্ত্র ব্যবহার করবেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তা নেভাতে জলাধারের ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রেই নেই। মঙ্গলবার শিলিগুড়ির প্রধানগরের হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে দুই তরুণ তরুণীর মৃত্যুর পরে তাই হোটেলের নিরাপত্তার প্রশ্ন জোরদার হয়ে উঠল। বারবার বলার পরেও হোটেল কর্তৃপক্ষের একাংশের তরফে সে ব্যাপারে কিছু করা বয়নি বলে অভিযোগ। পুলিশ প্রশাসন এবং দমকলের তরফেও এ ব্যাপারে উদাসীন থাকার জন্যই মঙ্গলবার প্রধাননগরের একটি হোটেলে আগুন লেগে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

Advertisement

মঙ্গলবার রাত ১টা নাগাদ হঠাত্‌ই হোটেলের রিসেপশন থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেন কর্মীরা। কয়েকজন কর্মী জানিয়েছেন, কর্মীরা দেখেন রিসেপশন ঘরটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। ততক্ষণে আগুন দেখে হোটেলের বাইরেও চেঁচামেচি শুরু হয়ে গিয়েছে। পুলিশ এবং দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, দোতলায় হোটেলের রিসেপশন এবং তার পিছনে থাকা সিঁড়ির ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া সিঁড়ি এবং আগুনের হলকায় হোটেলে থাকা পর্যটকরা নামতে পারেননি। নিরুপায় হয়ে মেঘালয়ের তুরার বাসিন্দা শিবপ্রসাদ পি হাজং পরিবার নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। ঘরের ভিতরে জল ছিটিয়ে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা চালান। যদিও বাকি পর্যটকেরা ছাদে উঠে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। দমকলের দু’টি ইঞ্জিন গিয়ে দু’ঘন্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন নেভার পরে পুলিশ এবং দমকলকর্মীরা আটকে থাকা পর্যটকদের উদ্ধার করেন। সে সময়েই সিঁড়িতে পড়ে থাকায় দুই তরুণ-তরুণীর দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার কাজের সময় জানলার কাঁচ ভেঙে মাথায় পড়ে এক পুলিশ আধিকারিক জখম হয়েছেন।

হোটেলের ৩০৩ এবং ৫০৩ নম্বর ঘর দু’টিতে আটকে ছিলেন কলকাতা থেকে আসা ১৪ জনের পর্যটকদের একটি দল। তাঁদের মধ্যে একজন দমদম নাগেরবাজারের কাজল মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “চিত্‌কার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। দরজা খুলে দেখি আগুনের হল্কা। তার সঙ্গে প্রচণ্ড ধোঁয়া ঘরে ঢুকতে থাকে। ভয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিছু পরে একজন দরজা খুলতে বলে। আমি খুললে তিনি ঘরে ঢুকে জানলার কাচ ভেঙে দেন। গ্রিল খুলে তিনি নেমে যান। পরে দমকল কর্মীরা এসে আমাদের উদ্ধার করেন।”

Advertisement

উদ্ধারের পরে পর্যটকদের পাশের দু’একটি হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মেঘালয়ে তুরা থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শিলিগুড়িতে এসেছিলেন শিবপ্রসাদ পি হাজম। তাঁর শাশুড়ি জয়ন্তী ছেত্রীর পা আগুনে পুড়েছে। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে এ দিন শিলিগুড়িতে পৌঁছন দেবরাজ কামির বাবা অজুর্নবাবু। তিনি বলেন, “একই ছেলে। প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করত। ওর বিয়ের কথাও চলছিল। আমার সর্বনাশ হয়ে গেল।”

বুধবার সকালে হোটেলে এসেছিলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। হোটেলের রিসেপশন সহ দোতলার কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত ঘর ঘুরে দেখেন মন্ত্রী। পুলিশ অফিসাররা মন্ত্রীকে জানান প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, রিসেপশনের টেবিলের পাশে থাকা বিদ্যুতের একটি প্যানেল বোর্ড থেকেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনা হল, আমরি কাণ্ডের পরে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীই শিলিগুড়ির বিভিন্ন বহুতল সব প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা কতটা রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে কয়েক দফায় বৈঠক করেছিলেন। বিরোধীদের প্রশ্ন, সে সময় বৈঠকে যা স্থির হয়েছিল, তা কী আদৌও মানা হয়েছে। এই ঘটনায় মন্ত্রী নিজেও বিরক্ত। তাঁর কথায়, “কোথাও আগুন লাগলে বৈঠক হবে, অনেক সিদ্ধান্ত হবে তার পরে সব ফের আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এটা চলছে পারে না। প্রধাননগরের হোটেলের ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছি। সেগুলি হাতে পেলে ফের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করব। ঠিক কোথায় গলদ হচ্ছে, তা খুঁজে বের করতে হবে।” প্রধাননগরের ওই হোটেলের পরিস্থিতি একটি উদাহরণ মাত্র। শহরের দুই শতাধিক হোটেলের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ নয় বলে অভিযোগ। দমকল এবং পুলিশের একাংশ কর্মী, আধিকারিকরাই তা জানিয়েছেন। এমনকী পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হোটেল মালিক সংগঠনের কর্মকর্তাদের অনেকেই। গ্রেটার শিলিগুড়ি হোটেল ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ বলেন, “পুরনো ভবনে যে সমস্ত হোটেল রয়েছে, সে ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে এটা ঠিক। তবে আমরাও সংগঠনের সদস্যদের জানিয়েছি, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ করতে। কেননা, এ ধরনের বিপদে হোটেলে থাকতে আসা পর্যটকরাই যে বিপদে পড়েন, তা নয় মালিককেও বিপাকে পড়তে হয়।”

দমকল সূত্রে জানা গিয়েছে, বহুতল হোটেলগুলিতে ওঠা নামার জন্য দু’টি অন্তত সিঁড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। পিছনের অংশে বা ধারে জরুরিভিত্তিতে বার হওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। তা ছাড়া অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, আগুন নেভাতে ভূগর্ভস্থ এবং ওভারহেড জলাধারের ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়। থাকতে হবে পাম্প মেশিন। তা ছাড়া, বহুতল হোটেলের সিঁড়ির প্রতিটি তলা থেকে বাইরে বার হওয়ার সহজ রাস্তা রাখতে হবে। দমকলের উত্তরবঙ্গের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক সনত্‌ মণ্ডল বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখি। সেই মতো প্রয়োজনীয় নির্দেশও দেওয়া হয়ে থাকে।” তবে তা কার্যকর হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা যে হয়নি, তা প্রধাননগরের ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।

ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন