দিলীপ সরকার। ফাইল চিত্র।
দুটি জায়গার দূরত্ব মোটে ১০ কিলোমিটার। একটি হল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দফতর। অন্যটি হল বিভাগীয় তদন্তে দোষী সাব্যস্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ সরকারের বাড়ি। যাঁকে গত ২১ জানুয়ারি কর্মসমিতি বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু, তিন সপ্তাহ কাটলেও কর্মসমিতির সেই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলীপবাবুকে কোনও চিঠি পৌঁছতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। উপরন্তু, রাত পোহালে সোমবার ফের কর্মসমিতির বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানে বিষয়টি নিয়ে ‘ঝড়’ উঠতে পারে পারে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই। উপাচার্য় সোমনাথ ঘোষ অবশ্য গোড়া থেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করছেন না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্রের দাবি, উপাচার্য আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে কর্মসমিতির আগের বৈঠকের সিদ্ধান্ত পরের বৈঠকে অনুমোদিত হওয়ার পরে চিঠি পাঠানোর পক্ষপাতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকে অবশ্য ওই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের অনেকেই জানান, ২০১২ সালে দিলীপবাবুকে যখন কর্মসমিতি সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়, সে যাত্রায় উপাচার্য় অরুণাভ বসু মজুমদার পরের সপ্তাহেই লোক মারফৎ দিলীপবাবুর বাড়িতে চিঠি পাঠিয়ে সেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেরই মতে, এ ক্ষেত্রেও বরখাস্তের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া যেত। কারণ, কর্মসমিতির কোনও বৈঠকে যে সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা পরের বৈঠকে অনুমোদিত হওয়াটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে তেমন হয়নি বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে।
যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার-কর্মী-অধ্যাপকদের একাংশ সন্দেহ করছেন, কোনও চাপের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতি শ্বীকার করেছেন। তাঁরা সামনে রাখছেন, দিলীপবাবুকে বরখাস্তের সিদ্ধান্তের কথা জানাজানি হতেই শিলিগুড়ির মেয়র তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য প্রতিবাদে সরব হওয়ার বিষয়টি। ‘দিলীপবাবুর মতো যোগ্য লোককে চক্রান্ত করে অমযার্দা করা হয়েছে’ বলে অভিযোগও করেছিলেন অশোকবাবু। সিপিএমের অন্দরে দিলীপবাবু অশোকবাবুর একান্ত ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। এমনকী, খোদ দিলীপবাবুর অনুগামীদের কয়েকজনও আইনি লড়াইয়ের পথে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এমনকী, শাসক দলের একাংশও দিলীপবাবুকে বরখাস্ত না করে স্বেচ্ছাবসরের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে নানা মহলে দরবার করেছিলেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার-কর্মীদের একাংশের অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সংগঠনের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি জানান, বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও তা জানাতে দেরি হলে হচ্ছে বলেই তো ‘রহস্য’ বাড়ছে।
ঘটনা হল, ৫ বছর আগে দিলীপবাবু সাসপেন্ড হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক থাকার সময়ে প্রায় কোটি টাকার বেশি দুর্নীতির অভিযোগে পুলিশে মামলা দায়ের করেছেন তৎকালীন উপাচার্য। বাম আমলে সেই মামলা দায়েরের পরে দিলীপবাবু সাসপেন্ড হন। সেই মামলার চার্জশিট দিতে পুলিশ গড়িমসি করছিল বলে অভিযোগ ওঠে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে বিষয়টি জানতে পেরে হস্তক্ষেপ করলে সাত দিনের মধ্যে পুলিশ চার্জশিট দেয়। এরই মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি নির্দোষ দাবি করে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন দিলীপবাবু। ইতিমধ্যে বিভাগীয় তদন্তে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। সেই বিভাগীয় তদন্ত বৈধ নয় জানিয়ে মামলা করেন দিলীপবাবু। সেই মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট অবধি।
২০১৫ সালের গোড়ায় সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, বিভাগীয় তদন্তের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্তিগ্রাহ্য পদক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু, নানা রাজনৈতিক নেতা-কর্তার হস্তক্ষেপে প্রক্রিয়া থমকে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি রোধের কাজে বাইরের কোনও চাপ সহ্য করা হবে না বলে নবান্নের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়ে দেন। এর পরে কর্মসমিতির বৈঠকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত হলেও তা কবে, কী ভাবে কার্যকর হয়, সেই আলোচনাতেই এখন বিশ্ববিদ্যালয় সরগরম।