রাজার পেয়াদার ভয় আজও পিছু ছাড়ছে না কোচবিহারের

কোচবিহার মানে যেন রাজ-কাহিনি। কোন রাজার আমলে কী হয়েছে, কোন রাজা কত প্রজাবৎসল, কোন রানি কত সুন্দর ছিলেন এমন নানা বিষয়ে অন্তহীন চর্চা। কিন্তু, একটা বিষয়ে সবাই মোটামুটি একমত। রাজপেয়াদার অত্যাচার। রাজারা ক্ষমতায় থাকতে পেয়াদাদের ব্যবহার করে কী ভাবে রাজ্য চালাতেন, সেই কাহিনি বংশপরম্পরায় শোনার সুবাদে এখনও অনেকের মুখেমুখে ফেরে। ভোটের আগে কোচবিহারে যেন অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সেই রাজা ও রাজপেয়াদার গল্প।

Advertisement

কিশোর সাহা

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০৪
Share:

কোচবিহার মানে যেন রাজ-কাহিনি।

Advertisement

কোন রাজার আমলে কী হয়েছে, কোন রাজা কত প্রজাবৎসল, কোন রানি কত সুন্দর ছিলেন এমন নানা বিষয়ে অন্তহীন চর্চা। কিন্তু, একটা বিষয়ে সবাই মোটামুটি একমত। রাজপেয়াদার অত্যাচার।

রাজারা ক্ষমতায় থাকতে পেয়াদাদের ব্যবহার করে কী ভাবে রাজ্য চালাতেন, সেই কাহিনি বংশপরম্পরায় শোনার সুবাদে এখনও অনেকের মুখেমুখে ফেরে।

Advertisement

ভোটের আগে কোচবিহারে যেন অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সেই রাজা ও রাজপেয়াদার গল্প।

কোচবিহার শহর থেকে দিনহাটা, সিতাই থেকে শীতলখুচি, মাথাভাঙা থেকে তুফানগঞ্জ, নাটাবাড়ি বহু এলাকাই কেমন থমথমে। বিরোধী দলগুলোর কর্মী-সমর্থকেরা হয় সিঁটিয়ে রয়েছেন, নয় গুটিয়ে রয়েছেন। ভাবগতিক দেখলে মনে হয়, পথে নামলে বা মুখ খুললেই ‘পেয়াদা ধরবে, বেঘোরে মরবে’ ধারণাটা মাথায় গেঁথে গিয়েছে।

গ্রামের পর গ্রামে বাম সমর্থকদের একটাই অভিযোগ। সন্ত্রাস। যেমন বাণেশ্বরের একাধিক চাষি অভিযোগ করেছেন, শাসক দলের ‘নিষেধ’ না মেনে মিছিলে যাওয়ায় বাগানের সব শাক-সব্জি ‘জরিমানা’ হিসেবে কে বা কারা তুলে নিয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জমা পড়ছে কোথাও প্রচার করতে গিয়ে বাম নেতা ঘেরাও হয়েছেন। কোথাও পার্টি অফিসে আগুন লাগানো হয়েছে। মারধর, হামলার আশঙ্কায় জেলায় বামেদের অন্তত শতাধিক অফিস পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে।

ঘটনা এটাও, যে বামেদের মিটিং-মিছিলে লোকজনও খুবই কম দেখা যাচ্ছে। ভোটের হপ্তাখানেক আগে খোদ সূর্যকান্ত মিশ্র কোচবিহারের উপকণ্ঠে ঘুঘুমারি এলাকায় রেললাইনের ধারে যে সভা করেছেন, তাতে লোক ছিল হাতেগোনা। অথচ, সেখানে জেলা বামফ্রন্টের প্রথম সারির নেতারা ছিলেন। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্তবাবুর বক্তৃতায় যত না ৩৪ মাসের ‘অপশাসনের’ কথা ছিল, সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি।

প্রবাদপ্রতিম বাম নেতা প্রয়াত কমল গুহের খাসতালুক দিনহাটার গ্রামাঞ্চলেও বামেদের যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকার উপক্রম। ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক কমল-তনয় উদয়ন গুহ বলছেন, “গত পঞ্চায়েত ভোটে যথেচ্ছাচার হয়েছে। তা-ও হাল ছাড়িনি। ধীরে ধীরে অনেক পার্টি অফিস খোলানো গিয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় বাহিনি পৌঁছেছে। নির্বাচন কমিশনও কড়া পদক্ষেপ করছে। ভোট অবাধে হলে আমাদের প্রার্থী দীপক রায় জিতবেনই।”

উদয়নবাবুদের আশার অন্যতম কারণ, সন্ত্রাস ও পক্ষপাতের অভিযোগ শুনে নির্বাচন কমিশনের ‘ফুল বেঞ্চ’ সম্প্রতি কলকাতার বৈঠকে কোচবিহারের জেলাশাসক মোহন গাঁধী ও পুলিশ সুপার অনুপ জায়সবালকে সতর্ক করেছে।

তবে ঝুলি হাতড়ে সন্ত্রাসের গল্প বার করছেন তৃণমূলের প্রার্থী রেণুকা সিংহও। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যের ঘটনা। তখন রেণুকা দেবী কংগ্রেস পরিচালিত কোচবিহার পুরসভার উপপুরপ্রধান। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলে কোচবিহারের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র পরিষদ করতেন।

তৃণমূল প্রার্থীর দাবি, ছাত্র পরিষদ করায় প্রায় প্রতি রাতেই হস্টেলে তাঁর ছেলে ও তার বন্ধুদের উপরে হামলা হতো। ভাতের থালায় ধুলো-মাটি ছড়িয়ে দেওয়া হতো। মারধর করা হতো। রেণুকাদেবীর কথায়, “এক বার মারের মুখে দোতলা থেকে লাফিয়ে পালাতে গিয়ে আমার ছেলে অজ্ঞান হয়ে যায়। আর হস্টেলে পাঠাইনি। ছেলেও রাজনীতি ছেড়ে দেয়। ২০০০ সালে দলের কিছু লোক ভোটে হারিয়ে দেওয়ায় আমিও রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছিলাম।”

তা হলে আবার সে পথে কেন?

রেণুকার জবাব, “ভোটে দাঁড়ানোয় ছেলে কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমার অনেক হেনস্থার জবাব দেওয়ার আছে। দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) সুযোগ দিয়েছেন বলে তা দিতে পারব।”

তা বলে ইটের বদলে পাটকেলের রাজনীতি?

নাটাবাড়ির অদূরে মেঠো-রাস্তায় ৪০ জনকে নিয়ে মিছিল করছিলেন তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। হাঁটতে হাঁটতেই বললেন, “সন্ত্রাসের গল্প বামেদের মুখে মানায় না। ওঁরা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন বিরোধীরা মিছিল করলে ঘরের হাঁস-মুরগি, ভেড়া, পাঁঠা নিয়ে যেতেন। রাতে ওঁদের পিকনিকের জন্য চাল, জ্বালানি কাঠও জোগাড় করে দিতে হতো। এর পরেও সন্ত্রাসের গল্প বামেরা বলেন কী করে?”

প্রায় আধ ঘণ্টা বাম-রাজত্বের নানা অত্যাচারের কাহিনি শুনিয়ে রবীন্দ্রনাথবাবু যখন মিছিল শেষ করলেন, তখন ৪০ জনের মিছিলে সামিল হয়েছেন অন্তত ৩০০ জন!

যা দেখে স্থানীয় এক শিক্ষক বললেন, “বামেদের সন্ত্রাস অতীত। ২০১১ ইস্তক কোচবিহারে নিজের জমি অনেকটাই শক্ত করে ফেলেছে তৃণমূল। এখন শাসক দলের মিছিলে এমনিতেই লোকে ভিড় করে। তার পরেও তারা সেই সন্ত্রাসের রাস্তাই বাছছে কেন, মাথায় ঢোকে না।”

হাসছেন নাটাবাড়ির তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথবাবু। বলছেন, “না না। সবাই নয়। কয়েক জন হয়তো পুরনো রাগ ভুলতে না পেরে, মেজাজ হারায়। তবে সে সংখ্যাটা নগণ্য।”

সন্ত্রাস নিয়ে চাপান-উতোরের এই কাহিনিতে বিজেপি, কংগ্রেসের খবর কী? আডবাণী আসবেন বলে ব্যাপক প্রচার চালানোর পরেও সেই সভা বাতিল হওয়ায় বিজেপি শিবির মুহ্যমান। যদিও মুখে প্রত্যয় দেখাচ্ছেন তাদের প্রার্থী হেমচন্দ্র বর্মন।

কংগ্রেস প্রার্থী কেশব রায়ও বলছেন, “ফাইট দেব।” তবে দলের অন্দরের খবর, ভোটের সাত দিন আগে পর্যন্ত ১৬ লক্ষ ভোটারের জেলায় রাহুল-সনিয়ার ছবি সম্বলিত ৭০ হাজার পোস্টার, লিফলেট, স্টিকার বিলি হয়েছে। দলের নেতারাই বলেছেন, প্রথমেই গাদাগাদা পোস্টার, লিফলেট ছেপে লাভ নেই। ঘরে পড়ে থাকলে পয়সা ও পরিশ্রম দুয়েরই অপচয় হয় যে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement