রামঘাট কাণ্ডে ভুল স্বীকার মন্ত্রীর

‘ঘরে বাইরে’ প্রবল চাপের মুখে পড়ে ‘রামঘাট-কাণ্ড’-এ তাঁর ভুল হয়েছিল বলে স্বীকার করলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। বুধবার দুপুরে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মহানন্দ মণ্ডলের নেতৃত্বে রামঘাটের বাসিন্দাদের কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৪১
Share:

উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরে মহানন্দ মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

‘ঘরে বাইরে’ প্রবল চাপের মুখে পড়ে ‘রামঘাট-কাণ্ড’-এ তাঁর ভুল হয়েছিল বলে স্বীকার করলেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। বুধবার দুপুরে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মহানন্দ মণ্ডলের নেতৃত্বে রামঘাটের বাসিন্দাদের কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। বৈঠকের পরে মন্ত্রী গৌতমবাবু বলেন, “কাজ করতে গেলে বিভিন্ন সময়ে ভুল হয়। সেটা সংশোধন করে নিতে হয়। আমরাও সাধারণ মানুষ। ত্রুটি বিচ্যুতি হতেই পারে। তাহলে জেদ ধরে বসে থাকাটা ঠিক নয়। সুখে দুঃখে মানুষের পাশে থাকাটাই আমাদের কাজ।” তবে কী ভুল হয়েছিল, সেই নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য, “অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে চাই না। সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই কাজ। গঠনমূলক সমালোচনা অবশ্যই গ্রহণ করব। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করাটাই আমাদের রীতি।”

Advertisement

৫ মাস আগে রামঘাটে বৈদ্যুতিক চুল্লির শিলান্যাস অনুষ্ঠানে প্রতিবাদে সরব মহানন্দ মন্ডলকে চড় মারার অভিযোগে গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে মামলা হয়। পক্ষান্তরে, মহানন্দবাবুর বিরুদ্ধেও নানা ধারায় মামলা হয়। তিনি গ্রেফতারও হন। তা নিয়ে এলাকা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। এলাকার তৃণমূলের অনেকেই দল ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। তা নিয়ে দলের অন্দরে চাপের মুখে পড়েন গৌতমবাবু। বিরোধীরা একজোট হওয়ায় বাইরেও চাপ বাড়ে। তৃণমূল সূত্রের খবর, এই অবস্থায়, আসন্ন পুরভোটের কথা মাথায় রেখেই ভুল স্বীকার করে দলকে চাঙ্গা করতে মরিয়া গৌতমবাবু।

প্রশাসনিক সূত্রের খবর, রামঘাটের ওই প্রতিনিধি দলের কাছে মন্ত্রী গোলমালের ঘটনায় পুলিশের করা মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তা কীভাবে নিস্পত্তি করা যায়, তা দেখার আশ্বাস দেন। আগামী ৮ মার্চ বিকালে রামঘাটে একটি সভা করার কথাও বলেন। ওই সভার পরের দিনই শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসার কথা রয়েছে।

Advertisement

যদিও মন্ত্রীর ভুল স্বীকারকে নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিরোধীরা। শুধু ভুল স্বীকার না করে এলাকায় গিয়ে মানুষের কাছে প্রকাশ্যে মন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে দাবি করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। বিরোধীদের অভিযোগ, গত সেপ্টেম্বরে মন্ত্রীর নির্দেশেই পুলিশ রামঘাটের ওই বাসিন্দাদের নামে একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করে। বহু বাসিন্দা জেলও খাটেন। এখন পুরভোটের মুখে সেই মামলা প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন্ত্রী এলাকায় সংগঠন গড়তে চাইছেন। তবে মন্ত্রীর যুক্তি, “এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা বা সমস্যা নেই। বিরোধীরা ও সব বলেই থাকেন। আমরা ওই এলাকার মানুষকে মূলস্রোতে রাখতে চাই। তাই মামলাগুলি কী করা যায়, সরকারি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলব।”

দলীয় সূত্রের খবর, গত কয়েক মাস ধরেই রামঘাটের গোলমাল নিয়ে দলের ভিতরে এবং বাইরে চাপে পড়েন মন্ত্রী গৌতমবাবু। ২৮ সেপ্টেম্বর বৈদ্যুতিক চুল্লির শিলান্যাস অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে চড় মারার অভিযোগ তোলেন মহানন্দবাবু। ওই সময় বিষয়টি আলোচনা করে মিটিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন দলের একাংশ। ওই নেতারা জানান, তা না করে উল্টে পুলিশ দিয়ে একের পর এক মামলা শুরু করে দেওয়ায় ওই এলাকা জুড়ে তৃণমূলের অস্তিত্বের সঙ্কট হয়ে পড়ে। বিষয়টি পুরমন্ত্রী ববি হাকিম থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবধিও পৌঁছয়। রামঘাটের কাজও বন্ধ করে দেওয়া হয়। দলীর স্তরেই মন্ত্রীর উপর চাপ তৈরি হয় বলে তৃণমূল নেতারা জানিয়ছেন।

সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস এবং বিজেপি নেতারা নিয়ম করে প্রায় রোজই রামঘাট-কাণ্ড নিয়ে মন্ত্রীকে দোষারোপ করা শুরু করেন। এলাকার আন্দোলনকারীদের পাশে ওই দলগুলি দাঁড়িয়ে যাওয়ায় গৌতমবাবুর সমস্যা বাড়তে থাকে। এমনকি, এলাকার এক পরিবহণ ব্যবসায়ীকে রাজি করিয়ে তৃণমূলের পার্টি অফিস খোলা হলেও তাতে আখেরে যে লাভ হচ্ছিল না, তা বিলক্ষণ বুঝে যান মন্ত্রী। দলের অন্দরের খবর, আসন্ন ভোটে এর প্রভাব পড়লে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তা ‘অন্য ভাবে’ নিতে পারেন বলে গৌতমবাবুর বুঝে যান। শেষ পর্যন্ত ওই এলাকায় পুরানো পরিচিতির সুবাদে তৃণমূল নেতা রঞ্জন শীলশর্মাকে ময়দানে নামিয়ে ভোটের মুখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা শুরু করেছেন।

এদিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর রামঘাটের বাসিন্দাদের তরফে মহানন্দবাবু বলেন, “এখানে কোনও রাজনীতি নেই। মন্ত্রী দেখা করতে চেয়েছিলেন, তাই আমরা এসেছিলাম। এদিন সব দলের লোকই ছিল। উনি মামলার নিস্পত্তির বিষয়টি দেখবেন বলেছেন। এলাকার সভা করার কথাও বলেছেন। দেখা যাক কী হয়!” গত মঙ্গলবারই তৃণমূল নেতা রঞ্জনবাবুই মহানন্দবাবুকে দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবও দেন বলে দলীয় সূত্রের খবর। উত্তরকন্যায় গিয়েও মন্ত্রীর সঙ্গে মহানন্দবাবু দেখাও করান।

মন্ত্রীর ভুল স্বীকারের চেষ্টাকে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা বলে কটাক্ষ করেছেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক অশোক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “গৌতমবাবুর উচিত এলাকায় গিয়ে প্রকাশ্যে মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া। আসলে উনি ঘরে-বাইরে চাপে পড়ে গিয়েছেন। আগে আলোচনা করেই তো কাজ করতে হয়। তা না করে উনি মারামারি করেছিলেন। এখন জল ঘোলা করে খেতে চাইছেন।” শুধু এলাকার মানুষ কেন, শহরের মানুষের কাছে মন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলেছেন বিজেপির জেলা সভাপতি রথীন বসু। তিনি বলেন, “কত লোকের নামে মামলা হল, সরকারি সম্পত্তি পুড়ল, আর এখন উনি বলছেন ভুল-ত্রুটি হয়েছে। ওঁর শহরের মানুষের কাছে ক্ষমা চাওয়া দরকার।”

জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা বিধায়ক শঙ্কর মালাকারের টিপ্পনী, “দলের বাইরের সমালোচনা তো আছেই, আমি যত দূর জানি, দলেও কোণঠাসা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী। ভুল স্বীকার করাটা মন্ত্রীর সেই অবস্থাই যেন স্পষ্ট করে দিল। এখন খোলা মঞ্চে গিয়ে শিলিগুড়ি শহরবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়াটা বাকি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন