নির্মাণে বিতর্ক

রাস্তা ঘেঁষে নির্মাণ, পুনর্বিবেচনা চায় সব পক্ষ

বিধান রোডের স্টেডিয়াম লাগোয়া এলাকায় রাস্তার গা ঘেঁষে বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়া হলে যে ভবিষ্যতে নানা জটিলতা তৈরি হবে তা এখন বুঝতে পারছেন পুরসভার প্রাক্তন কর্তাদের অনেকেই। এমনকী, পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের প্রাক্তন মেয়র পারিষদদের প্রায় সকলেই এখন চাইছেন, আগামী দিনে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটা মাথায় রেখে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ করা দরকার।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:২০
Share:

‘বির্তকিত’ ভবনের নির্মাণে রাস্তার উপরেই লাগানো হয়েছে বাঁশ। ফলে নিত্য যানজট। ছবি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।

বিধান রোডের স্টেডিয়াম লাগোয়া এলাকায় রাস্তার গা ঘেঁষে বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়া হলে যে ভবিষ্যতে নানা জটিলতা তৈরি হবে তা এখন বুঝতে পারছেন পুরসভার প্রাক্তন কর্তাদের অনেকেই। এমনকী, পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের প্রাক্তন মেয়র পারিষদদের প্রায় সকলেই এখন চাইছেন, আগামী দিনে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে সেটা মাথায় রেখে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ করা দরকার। সিপিএম, সিপিআই ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি, সব দলের কাউন্সিলরদের অনেকেই এখন ওই বাণিজ্যিক কেন্দ্র নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার পক্ষে মত দিয়েছেন। শিলিগুড়ি নাগরিক সমিতির পক্ষ থেকে এসজেডিএ ও বেসরকারি সংস্থা যৌথ উদ্যোগে হতে চলা ওই বাণিজ্যিক প্রকল্পটি নিয়ে পুনর্বিবেচনার দাবি তোলা হয়েছে।

Advertisement

ওই সমিতির অন্যতম দুই কর্তা দূর্গা সাহা ও সুজিত বসু একযোগে বলেছেন, “যিনি এসজেডিএ-র চেয়ারম্যান থাকার সময়ে ওই প্রকল্পের ব্যাপারে বেসরকারি নির্মাণ সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হয়, সেই প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেছেন, ওখানে প্রকল্পটি না হলেই ভাল হতো। এসজেডিএ-র বর্তমান চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব ওই বেসরকারি সংস্থাকে বিনিয়োগের টাকা সুদ-সহ ফিরিয়ে জায়গাটি নিয়ে জনস্বার্থে ব্যবহারের কথা বলেছেন। তা হলে প্রকল্পটি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে অসুবিধা কোথায়? শিলিগুড়ির আমজনতার স্বার্থে ওই প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে ভাবা হোক। শহরের সব নাগরিকদের আমরা ওই দাবিতে সামিল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।” এর পরে সুজিতবাবুর আশঙ্কা, “ওই প্রকল্প হলে বিধান রোডে নিত্য দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হোক।”

বস্তুত, বিধান রোডের গা ঘেঁষে যে প্রকল্প তৈরি হচ্ছে তাতে সরকারি বিধি মেনে বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট নেওয়া হয়েছে কি না তা নিয়েও বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, একদিকে ব্যস্ত সড়ক, অন্যদিকে হাইড্রেনের গা-ঘেঁষে থাকা শিলিগুড়ির বিধান রোডের ‘বিতর্কিত’ নির্মীয়মান বাণিজ্যিক ভবন কতটা নিরাপদ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পুরসভা এবং কর্পোরেশন এলাকায় বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে কী বিধি নিষেধ মানতে হয় তার জন্য একটি সর্বভারতীয় মাপকাঠি রয়েছে। ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড কোড ফর বিল্ডিং ডিজাইন এবং ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অব ইন্ডিয়া এই দুই মাপকাঠি মানা হয়েছে কি না খতিয়ে দেখেই ভবন নির্মাণের ছাড়পত্র দেওয়া হয় বলে জানা গিয়েছে। পূর্ত দফতরের একাংশ আধিকারিক জানিয়েছেন, ব্যস্ত রাস্তা থেকে অন্তত ৮ ফুট দূরে বহুতল নির্মাণ না হলে তা মোটেই নিরাপদ নয়, তেমনিই ভবনের অন্তত ৬ ফুটের মধ্যে কোনও জলাশয় বা নিয়মিত জল জমে থাকা এমন জমি থাকা নিরাপদ নয়। ব্যস্ত রাস্তায় সবসময়ে গাড়ি চলাচল করতে থাকায় পাশেই থাকা বহুতলের ভিত খুব একটা মজবুত না হওয়ার আশঙ্কা যেমন থাকে, তেমনিই পাশেই জলাশয় থাকলে জল চুঁইয়ে মাটি ক্ষয় হয়ে ভিতের একাংশ ধসিয়ে দেওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

Advertisement

যে সংস্থাটি এসজেডিএ-র সঙ্গে যৌথভাবে ওই নির্মাণ করছে তার কর্ণধার নিরঞ্জন মিত্তল অবশ্য জানিয়েছেন, তাঁরা সব নিয়ম মেনেই কাজ করছেন। কিন্তু, সর্বভারতীয় মাপকাঠি অনুযায়ী দুই ঝুঁকির যে উল্লেখ করা হয়েছে, শিলিগুড়ির ওই ভবন তা মেনে তৈরি হচ্ছে কি না সেটা খতিয়ে দেখার দাবি তুলেছেন বিধান রোডের ব্যবসায়ীদের একাংশ। বিধান রোডের মতো ব্যস্ত এলাকা যেখানে সারাদিন-রাত ছোট, মাঝারি এবং ভারী যানবাহন চলাচল করে, সেই রাস্তার ফুটপাতের জায়গা থেকেই শুরু হয়েছে ভবনটি। অন্যদিকে, হাইড্রেনের গার্ড ওয়াল এবং ভবনের দেওয়ালের মাঝে রয়েছে, অন্তত ২ আড়াই ফুট, কোথাও বা আরও কম জায়গা নিয়ে তৈরি ‘অ্যাপ্রন’। পূর্ত দফতরের একাংশ বাস্তুকারদের মতে, একদিকে ব্যস্ত রাস্তায় থাকায় ভিত কতটা শক্তিশালী হয়েছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে, অন্যদিকে হাইড্রেন থেকে জল চুঁইয়ে ভিতের গাঁথনি আলগা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। বছর কয়েক আগে নির্মীয়মাণ ভবনের একদিকের সিড়ি এবং দেওয়ালের অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। সেই ভাঙাভাঙির কাজেও চারতলা ভবনের ভিত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

পুরসভা সূত্রের খবর, রাস্তা সম্প্রসারণ হওয়ার পরে ২০১২-র মে মাসে ভবনের পরিবর্তিত নকশা অনুমোদন করা হয়। সে সময় অবশ্য নির্মীয়মাণ ভবনটি ফের খতিয়ে দেখা হয়েছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সে সময় কংগ্রেসের পুরবোর্ড ছিল। বিল্ডিং বিভাগের মেয়র পারিষদ ছিলেন সীমা সাহা। তিনি বলেন, “আগেই ওই ভবনের নকশা অনুমোদন করা ছিল। আমাদের কিছু করার ছিল না। আমি মনে করি, শহরের ওই অংশে রাস্তার ধার ঘেঁষে এ ভাবে বাণিজ্যিক ভবন হওয়াটা কাম্য নয়।”

পুরসভা সূত্রের খবর, বাম জমানায় ওই ভবনের নকশা অনুমোদন করা হয়েছিল। তখন বিল্ডিং বিভাগের মেয়র পারিষদ ছিলেন পার্থ চৌধুরী। তিনি বলেন, “নিয়ম মেনে সে সময় বিল্ডিং প্ল্যান পাশ করানো হয়েছিল। জমি যতটা ছাড়ার কথা ততটাই ছাড় দিয়ে প্ল্যান করা হয়েছিল। শহর দ্রুত গতিতে বেড়ে ওঠার কথা মাথায় রেখে ওই জায়গায় বাণিজ্যিক ভবন না হওয়াটাই কাম্য।”

ঘটনা হল, শুরু থেকেই ওই ভবন তৈরি নিয়ে বির্তক রয়েছে। ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর নিম্নমানের জিনিস দিয়ে নির্মাণ কাজের অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় নির্মীয়মাণ ছাদ ভেঙে পড়ে। পার্থবাবু জানান, এর পর থেকে তারা কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পার্থবাবুর দাবি, পরে বাম জামানায় আর ওই ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

কংগ্রেস-তৃণমূল জোট বেঁধে পুরবোর্ড দখল করার পর ‘বিল্ডিং’ বিভাগের দায়িত্বে অধিকাংশ সময় ছিলেন মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত। তিনি বলেন, “ওই অংশে নির্মাণ নিয়ে কোনও সমস্যা বা অভিযোগ যখন উঠছে তখন এখন যাঁরা পুরসভা চালাচ্ছেন তাঁরা হাত গুটিয়ে না থেকে পদক্ষেপ করুন।” একদা কংগ্রেসের এখন তৃণমূলে রয়েছেন প্রাক্তন মেয়র পারিষদ (বিল্ডিং) সঞ্জয় পাঠক বলেন, “ওই বাণিজ্যিক কেন্দ্র ওখানে করা যুক্তিযুক্ত কি না তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।” নির্মাণকারী সংস্থার তরফে রতনকুমার বেনিপুরির দাবি, ভবন তৈরির জন্য পুরসভা ছাড়পত্র দিয়েছে। সব নিয়ম মানা হয়েছে কি না সেটা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব পুর কর্তৃপক্ষেরই। তিনি বলেন, “রাস্তার পাশেই ভবন তৈরি হয়নি। যে সময় ভবন তৈরি হয়েছিল তখন রাস্তা অনেক দূরে ছিল। পরে রাস্তা সম্প্রসারণ হয়ে কাছে চলে আসে। যা হয়েছে আইন মেনেই হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন