এই বাঘাযতীন পার্ক সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পুরভোটের দিনক্ষণ এখনও ঠিক হয়নি। কবে হবে, তা-ও কেউ জানেন না। তাতে কী! লোকসভা ভোটের ফল যেন তাড়া করে বেড়াচ্ছে তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা নেতৃত্বকে। তাই ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়ে বিশ্বকাপের বাজারেও সাতসকালে উঠে পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরতে হচ্ছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে। রাত জেগে খেলা দেখার পরে ভোরবেলায় নদীর ধারের কলোনিতে হেঁটে বাসিন্দাদের সঙ্গে ‘সুখ-দুঃখ’র গল্প করতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে।
কলোনির বাসিন্দাদের ঘরে ঢুকে সকালের চা-টাও খাচ্ছেন মন্ত্রী। এমনকী, রবিবার বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনও সকালে ১৭ নম্বর ওয়ার্ড লাগোয়া ফুলেশ্বরী নদীর ধারের কলোনিতে প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল মন্ত্রীকে। সেখানে কলোনির বাসিন্দা তথা নার্সিংহোমের আয়া পুষ্প দাস অত সকালে মন্ত্রীকে দেখে তো অবাক। মন্ত্রী সটান দাওয়ায় বসে খবরাখবর নিলেন। নদীর ধারে আবর্জনার স্তূপ, বেআইনি দখলদার দৌরাত্ম্যের কথা শুনলেন। চা খেলেন। বেরনোর সময়ে মন্ত্রীকে বলতে শোনা গেল, “বৌদি, দুশ্চিন্তা করবেন না। আমরা ব্যবস্থা নেব।”
বস্তুত, লোকসভা ভোটে শিলিগুড়ি পুরসভার বিস্তীর্ণ এলাকায় অন্য সব দলকে পিছনে ঠেলে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। পুরসভার ৪৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত ২১টি ওয়ার্ডে এগিয়ে বিজেপি। তৃণমূল ২২টি ওয়ার্ডে এগিয়ে। মাত্র ৪টিতে এগিয়ে বামেরা। অনেক জায়গায় ঘাসফুলের ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে পদ্মফুল। তা নিয়ে দলের অন্দরেই সমালোচিত হয়েছেন তৃণমূলের দার্জিলিং জেলা নেতারা। সম্প্রতি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় শিলিগুড়িতে কর্মিসভায় যোগ দিতে গিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের বারেবারেই ওই ফল থেকে ‘শিক্ষা’ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তৃণমূলের অন্দরের খবর, খোদ মুখ্যমন্ত্রী দলনেত্রী মমতা বেন্দ্যোপাধ্যায় শিলিগুড়ি পুর এলাকায় আসন্ন পুরভোটে ভাল ফল না হলে যে দলীয় পর্যায়ে কঠোর পদক্ষেপ করবেন, সেই বার্তাও দিয়েছেন। ইতিমধ্যেই জলপাইগুড়িতে দুটি লোকসভা আসনে জয়ের পরে রাতারাতি সেখানকার জেলা সভাপতিকে সরিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সৌরভ চক্রবর্তীর মতো তরুণ প্রজন্মের নেতাকে জলপাইগুড়ি ও সদ্যগঠিত আলিপুরদুয়ারের দায়িত্ব দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
সদ্যসমাপ্ত লোকসভা ভোটে দার্জিলিং কেন্দ্রে বিজেপি-র কাছে পর্যুদস্ত হয়েছে তৃণমূল। শিলিগুড়ি পুরসভার বিস্তীর্ণ
এলাকায় তৃণমূল প্রার্থী ভাইচুং ভুটিয়া পিছিয়ে। তবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের নিজের ওয়ার্ডে (১৭ নম্বর)
বিপক্ষের চেয়ে অনেক এগিয়ে। শিলিগুড়িতে তৃণমূলের বিপর্যয় নিয়ে ঘরে-বাইরে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অন্যত্র যাই-ই হোক অন্তত
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী নিজের ওয়ার্ডের দলের লোকসভার প্রার্থী এগিয়ে থাকায় এমনই ধন্যবাদ জ্ঞাপক ফ্লেক্স টাঙানো হয়েছে।
এই অবস্থায় বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ ঘনঘন শিলিগুড়ি যাতায়াত করছেন। শিলিগুড়ি পুরসভা দখল করে রাজ্যে ফের পরিবর্তনের সূচনা করার ডাক দিয়েছেন রাহুলবাবুরা। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, কেপিপি-ও বিজেপি-র সঙ্গে জোট বেঁধে পুরভোটে লড়ার কথা ঘোষণা করেছে। বিজেপি-র দার্জিলিং জেলা সভাপতি রথীন্দ্র বসুর কথায়, “স্থায়ী ও শক্তিশালী পুরবোর্ডের জন্যই বিজেপি জোটকে মানুষ ভোট দেবেন।” কংগ্রেসও আর জোটে নেই। কংগ্রেসের কাউন্সিলর তথা দলের দার্জিলিং লোকসভার পরাজিত প্রার্থী সুজয় ঘটক জানান, তাঁরা বিনা লড়াইয়ে জমি ছেড়ে দেবেন না। কংগ্রেস এককভাবে লড়ার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বামেরাও প্রতিনিয়ত রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মিটিং-মিছিল করছেন। আগামী ১৬ জুলাই মুখ্যমন্ত্রীর ফের উত্তরবঙ্গ সফরে আসার কথা। সেই সময়ে ১৮ জুলাই শিলিগুড়িতে মিটিং-মিছিল করার জন্য অনুমতি চেয়েছেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। ফলে বাইরেও চাপ ক্রমশ বাড়ছে।
তৃণমূল বিরোধী সব দলই প্রচারে বেরিয়ে প্রশ্ন তুলছে, বামেদের হটিয়ে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের হাতে পুরবোর্ড তুলে দিয়ে কী লাভ হয়েছে? কেন সাড়ে ৪ বছরও ঠিকঠাক চলল না পুরবোর্ড জোটের আকচাআকচির জেরে পুরসভায় বড় কোনও প্রকল্পের কাজ হয়নি। অথচ কাউন্সিলরদের একাংশের বাড়ি-গাড়ি-জমি-পুকুর-বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠলেও দলীয় পর্যায়ে কেন তদন্ত হয়নি? কেন কাউন্সিলরদের সম্পত্তির খতিয়ান প্রকাশ্যে পেশ হবে না?
শিলিগুড়ি শহরের বাতাসে এমনই নানা প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা আঁচ করেই আমজনতার মনে ওঠা প্রশ্ন, ক্ষোভ প্রশমিত করার তাগিদে ঘুম ছুটেছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর। সরকারি অফিসার, ইঞ্জিনিয়রদের নিয়ে ঘুরছেন ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে। কখনও চিলড্রেন পার্কের কাজ কতটা এগোচ্ছে সেটা দেখছেন। আবার বাঘা যতীন পার্কের সংস্কারের কাজে ঢিলেমি হচ্ছে কি না, সেটা দেখছেন। রোজই বাসিন্দাদের কাছ থেকে অভিযোগ, অনুযোগ শুনতে হচ্ছে মন্ত্রীকে। রাস্তাঘাট, জঞ্জাল সাফাই, পানীয় জলের পরিষেবা নিয়েই অভিযোগ বেশি।
এত সবের মধ্যেও মন্ত্রীকে একটু স্বস্তি দিচ্ছে তাঁর নিজের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড। যেখান থেকে তিনি একাধিকবার জিতেছেন। এখনও কাউন্সিলর। গত লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে সেই ওয়ার্ডে তৃণমূল অন্য সব দলের থেকে এগিয়ে রয়েছে। সে জন্য মন্ত্রী ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের ধন্যবাদ জানিয়ে পেল্লায় সাইনবোর্ডও দিয়েছেন। এ বার ওই ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। ফলে মন্ত্রী হয় ১৫ না হলে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে দাঁড়াতে পারেন বলে দলের অন্দরে খবর। মন্ত্রী অবশ্য বলছেন, “ভোটে দাঁড়ানোর ব্যাপারটা দলের উপরে নির্ভর করবে। এখন আমার লক্ষ্য আমরা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা কতটা করেছি, কতটা পারিনি সেই হিসেবটা মেলানো। সেটাই বুঝতে চাইছি। যে কাজ বাকি তা জরুরি ভিত্তিতে করছি।”
—নিজস্ব চিত্র।