সহকারী ম্যানেজার অজিত পানোয়ারের দেহ।
এক মহিলা শ্রমিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে চা বাগানের এক সহকারী ম্যানেজারকে খুকুরি দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হল। বৃহস্পতিবার ডুয়ার্সের বীরপাড়া থানা এলাকার দলমোড় চা বাগানে এই ঘটনার পরে পুলিশ ওই মহিলার স্বামী শোভেন রানা ও তাঁর খুড়তুতো ভাই বিকাশ রানাকে গ্রেফতার করেছে। শোভেনবাবুর ছেলেও এই ঘটনায় অভিযুক্ত। নিহত সহকারী ম্যানেজারের নাম অজিত পানোয়ার (৩৬)। বাড়ি উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগর। এই বাগানে তিনি অবশ্য একাই থাকতেন।
অজিতবাবুর গলায়, পেটে, বুকে ও হাতে বেশ কয়েক বার কোপ দেওয়া হয়েছে। খুনের পরে বাগানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছে, অজিতবাবু এ দিন সকালে শোভেনবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিলেন। তার জেরেই এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও বাগান সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই মহিলা তাঁর জন্য নির্দিষ্ট সেকশনে কাজ না করে এ দিন অন্য একটি সেকশনে গিয়ে চা-পাতা তোলার কাজ করছিলেন। সকাল ৮টা নাগাদ বাগান পরিদর্শন করতে গিয়ে অজিতবাবু তা দেখতে পান। তিনি দেখেন, ১৮ নম্বর সেকশনে ১০ জন মহিলা শ্রমিকের জায়গায় ১১ জন পাতা তুলছেন। অজিতবাবু তখন তার কারণ জানতে চান। শ্রমিকরা সে সময়ে তাঁকে জানান, ওই মহিলার অন্য সেকশনে কাজ করার কথা থাকলেও তিনি সেখানে যাননি। এমনকী, ওই মহিলা এ দিন দেরিতে কাজ শুরু করেছেন বলেও শ্রমিকরা অভিযোগ করেন।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, অজিতবাবু তখন ওই মহিলাকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট সেকশনে যেতে পরামর্শ দেন। তা নিয়েই দু’জনের বচসা বাধে। প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকরা জানান, অজিতবাবু ওই মহিলার চা-পাতার ঝোলা কেড়ে নিয়ে ঝোপে ছুড়ে ফেলে দেন। ওই মহিলার অভিযোগ, তাঁর উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য করেন এবং কিল মারেন সহকারী ম্যানেজার।
মূল অভিযুক্ত শোভেন রানাকে আনা হচ্ছে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে।
মহিলার স্বামী শোভেনবাবু ওই বাগানেরই শ্রমিক। তবে সম্প্রতি ছুটি নিয়ে কাঁচা আনাজের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এ দিন কৃষকদের কাছ থেকে সব্জি কিনে বাড়ি ফেরার পথে শোভেনবাবু শুনতে পান, বাগানে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তাঁর স্ত্রী সেই ঘটনায় জড়িত, এ খবরও পান। ইতিমধ্যে বাগানে হইহল্লা শুরু হয়ে যায়। ওই মহিলাও এলাকার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা তথা পঞ্চায়েত সদস্যের কাছে গিয়ে অজিতবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। পুলিশ জানতে পেরেছে, এর মধ্যে শোভেনবাবু বাড়ি গিয়ে জামার ভিতরে একটি খুুকুরি নিয়ে অজিতবাবুকে খুঁজতে বার হন। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে আরও তিন জন ছিলেন বলে পুলিশের সন্দেহ।
সওয়া ৯টা নাগাদ শোভেনবাবু ম্যানেজারকে বাগানের এক জায়গায় পেয়ে কথা বলতে চান। একটু আড়ালে যেতেই শোভেনবাবু খুকুরি বার করে অজিতবাবুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন বলে অভিযোগ। তাঁকে তিনি খুকুরি দিয়ে কোপাতে থাকেন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় অজিতবাবুর। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, বিকট চিৎকার করে শোভেনবাবু নিহত অজিতবাবুর হাতেও পরপর কোপ দিতে থাকেন। দু’টি হাতই শরীর থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এলোপাথাড়ি কোপ দিতে গিয়ে নিজেও জখম হন শোভেনবাবু। আতঙ্কে বাগানের সব শ্রমিকরা পালিয়ে যান। পুলিশ জানায়, খুনের পরে শোভেনবাবু তাঁর নিজের বাড়ির বারান্দার সামনেই বসেছিলেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করলে তিনি কোনও বাধা দেননি।
শোভেনবাবুরা ওই বাগানের বাঁশবাড়ি লাইনের বাসিন্দা। তাঁদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। গত মার্চে এক মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাঁর স্ত্রী বলেন, “ওই ম্যানেজার আমার সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করেছেন। আমি তার প্রতিবাদ করায় তিনি আমাকে আরও অপমান করেন। পিঠে কিলও মারেন। তার পরে পঞ্চায়েত সদস্যের সঙ্গে কথা বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাব ভাবছিলাম। তার মধ্যেই শুনি ওই ম্যানেজারকে খুন করা হয়েছে। আমার স্বামীকে তার পরে পুলিশ গ্রেফতার করে।” তাঁর বক্তব্য, “আমার ছেলের নাম এই ঘটনায় জড়ানো অনুচিত। সে এখানে ছিলই না।” বীরপাড়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য মোর্চা নেতা কিসমৎ প্রধান বলেন, “ওই সহকারী ম্যানেজার শ্রমিকদের সঙ্গে খুবই দুর্ব্যবহার করতেন। বেশি সময় ধরে কাজ করতেও বাধ্য করতেন বাগান কর্তৃপক্ষ। তাই মানুষের ক্ষোভ ছিলই।”
চা বাগানের মধ্যে সম্প্রতিক অতীতে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের এমন পরিণতি দেখা যায়নি। ২০০৩ সালের ৬ নভেম্বর বীরপাড়ারই দলগাঁও চা বাগানে সিটু নেতা তারকেশ্বর লোহার সহ ১৯ জনকে বাড়ির মধ্যেই ঘিরে পিটিয়ে, কুপিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ওই মামলায় ১১৩ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও এখনও চার্জ গঠন হয়নি। আসামি পক্ষের আইনজীবী সমীর সরকার বলেছেন, “মোট ৫ জন আসামির মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ সময় মতো ‘ডেথ রিপোর্ট’ না পাঠানোয় মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে।”
এ দিন দলমোড় চা বাগানের ঘটনার পরে জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, “এক মহিলা শ্রমিকের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তুলে ওই সহকারী ম্যানেজারকে খুন করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে মহিলার স্বামী সহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও দু’জনকে খোঁজা হচ্ছে।” আহত শোভেনবাবুকে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
এই বাগানে মোট বারোশো শ্রমিক কাজ করেন। ২০১২ সালে প্রায় ১০ মাস শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বাগানটি বন্ধ ছিল। পরে শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকে লিখিত ভাবে অশান্তি না করার আশ্বাস পাওয়ার পরে কর্তৃপক্ষ আবার বাগান চালু করেন। এ দিনের ঘটনার পরে বাগানমালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মুখ্য উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, “এ ধরনের হিংস্র আক্রমণের ঘটনা আগে ঘটেছে বলে আমার মনে পড়ছে না। তবে এমন চলতে থাকলে বাগানের স্বাভাবিক কাজকর্ম চলা অসম্ভব হয়ে পড়বে।” দলমোর বাগানের ম্যানেজার অজয় সিংহও বলেন, “আমরা খুবই আতঙ্কিত। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না। বাগান খুলতে পারব কি না, জানি না।” তবে চা শ্রমিকদের আরএসপি ও কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত দুই সংগঠনের নেতা যথাক্রমে গোপাল প্রধান ও মনি ডারনালের দাবি, অপরাধীদের শাস্তি হোক। কিন্তু চা বাগানটি যেন স্বাভাবিক ভাবে চলে, তা দেখতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
বৃহস্পতিবার রাজকুমার মোদক, সন্দীপ পালের ছবি।