হিলির আপতোর মৌজার এই জমিই চিহ্নিত করা হয়েছে। ছবি: অমিত মোহান্ত।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে জমিদাতাদের একাংশের আপত্তিতেই এইমসের ধাঁচে হাসপাতাল হয়নি। অনিচ্ছুকদের সেই আন্দোলনে তৃণমূলের সমর্থন রয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছিল কংগ্রেস। দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলিতে অবশ্য জমি-সমস্যা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক স্থলবাণিজ্য বন্দর (ল্যান্ড পোর্ট) তৈরিতে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বকেই। শাসক দলের এই উদ্যোগকে কটাক্ষ করেছে বিরোধীরাও।
হিলি সীমান্তের আপতোর এলাকায় ২০৮ একর এবং ধারান্দা এলাকায় ৫ একর মিলিয়ে মোট ২১৩ একর কৃষি জমি চিহ্নিত করে দিল্লিতে ল্যান্ড পোর্ট তৈরির প্রস্তাব পাঠিয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রশাসন। জমি চিহ্নিত করার কাজে উদ্যোগী হন হিলির তৃণমূল নেতা তথা জেলা প্রাথমিক স্কুল সংসদের চেয়ারম্যান কল্যাণ কুণ্ডু। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে হিলিতে বাণিজ্য বন্দর গড়তে অন্তত ১০০ একর জমির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছিল। জেলাশাসক তাপস চৌধুরী বলেন, “গত ১৮ জুন ওই জমি সংক্রান্ত নথি ল্যান্ড পোর্ট অথরিটিকে পাঠানো হয়েছে। দিল্লির রাজ্যের প্রিন্সিপাল রেসিডেন্ট কমিশনারকেও নথিপত্র পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানালে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।” কল্যাণবাবুর দাবি, “ওই জমির মালিকদের অধিকাংশই উন্নয়নের স্বার্থে জমি দিতে রাজি। রাজ্য সরকারও সম্মতি দিয়েছে।”
১৯৯৪ সালে হিলি আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বহির্বাণিজ্য চালু হয়। বর্তমানে ওই বাণিজ্য বেড়ে ফি বছর গড়ে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। রোজ গড়ে প্রায় দেড়শো পণ্য বোঝাই ট্রাক হিলি দিয়ে বাংলাদেশে মাল খালাস করতে গিয়ে ব্যাপক যানজট-সহ নানা সমস্যার মধ্যে পড়ে। একই ছাতার তলায় ট্রাক টার্মিনাস, হোটেল, চালকদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা, শুল্ক দফতর, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় কেন্দ্র, অভিবাসন দফতর, গুদাম-সহ বহির্বাণিজ্যের আধুনিক সুবিধা-যুক্ত স্থল-বন্দর গড়তে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন।
প্রশাসন সূত্রের খবর, হিলি দক্ষিণপাড়া এলাকায় যমুনা নদীর তীরবর্তী এবং বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কার্যত অনুর্বর জমিতে বাণিজ্য বন্দর গড়ার জন্য প্রথম পর্যায়ে কেন্দ্র থেকে তিন কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়। এক কোটি টাকা জেলাশাসকের দফতরে চলেও আসে। গত ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা ভূমি রাজস্ব দফতর থেকে ওই এলাকায় নিজস্ব তিন একর খাস জমি রাজ্যের শিল্প বাণিজ্য দফতরে হস্তান্তর করা হয়। এর পরে দিল্লি থেকে ল্যান্ডপোর্ট অথরিটির সদস্য অনিল বাম্বার নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল হিলিতে আসেন। তবে দক্ষিণপাড়ার ওই জমি দেখে তাঁরা জানান তা তাঁদের পছন্দ নয়।
তৃণমূল নেতা কল্যাণবাবু বলেন, “সেই সময় হিলির উত্তর দিকে আপতোর মৌজার জমি তাঁদের দেখানো হলে তাঁরা সম্মতি জানান। এর পর জেলা প্রশাসন থেকে ওই ২১৩ একর জমি চিহ্নিত করে জমির ম্যাপ দিল্লিতে পাঠানো হয়।”
তবে এখনই আশ্বস্ত হতে রাজি নন অনেকেই। হিলি কাস্টমস এন্ড ক্লিয়ারিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক অশোক মণ্ডল জানান, ২০০৬ সালে কেন্দ্রের প্রতিনিধি দল এলে হিলির দক্ষিণপাড়া এলাকায় বিএসএফ ফাঁড়ির পাশে ফাঁকা জায়গা দেখে যান। এখন আবার ওই জায়গা থেকে সরে গিয়ে আপতোর মৌজার কৃষিজমি চিহিৃত করা হয়েছে। এই টালবাহানার ফলে আদৌ প্রকল্পটি গড়তে প্রশাসন আগ্রহী কি না, তা নিয়ে অনেক ব্যবসায়ীই সন্দিহান বলে অশোকবাবু অভিযোগ করেছেন।
কল্যাণবাবুও জানান, প্রথম পর্যায়ের বরাদ্দ এক কোটি টাকা এখনও পড়ে রয়েছে। তিনি বলেন, “কয়েক বছর ধরে পড়ে থাকা ওই ১ কোটি টাকার কী হবে, তা জানতে চেয়েও জেলা প্রশাসন থেকে চলতি বছরের জুন মাস থেকে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট রাজ্য ও কেন্দ্রীয় দফতরে চিঠি পাঠানো হলেও এখনও পর্যন্ত উত্তর মেলেনি।”
আপতোর মৌজার ওই জমির মালিক রয়েছেন অন্তত ৬৫ থেকে ৭০ জন। প্রত্যেকের জমির পরিমাণ ১০ বিঘা থেকে ১ বিঘার মধ্যে। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ কুণ্ডুু, গৌর কুণ্ডুু, গোবিন্দ কুণ্ডুু, নির্মল কুণ্ডু, সিধু ওঁরাওরা বলেন, “আমাদের এলাকার জমি চিহ্নিত হয়েছে বলে শুনেছি। জমির বর্তমান বাজার মুল্য বিঘা প্রতি প্রায় দু’লক্ষ টাকা। জমির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে সরকারকে জমি দিতে কোনও আপত্তি নেই।” নির্ধারিত ওই জমির মধ্যে মিশনপাড়া এলাকার ২৯ ঘর আদিবাসী পরিবার রয়েছেন। ওই এলাকার বাচ্চু ওঁরাও, লক্ষণ ওঁরাওরা বলেন, “আমাদের চাষের জমি পড়েনি। তবে ঘরবড়ির জন্য পাশ্বর্বর্তী কোনও জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতিপূরণও দিতে হবে।” ওই এলাকার তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য ভারতী ওঁরাও বলেন, “হিলির উন্নয়নের স্বার্থে মোটামুটি সকলেই জমি দিতে এগিয়ে এসেছেন। যাঁরা ধন্দে আছেন, তাঁদেরও আমরা বুঝিয়ে রাজি করাব।”
তবে জমি চিহ্নিতকরণে শাসক দলের নেতাদের এই উদ্যোগকে কটাক্ষ করেছেন বিরোধীরা। এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য তথা আরএসপির জেলা কমিটির সদস্য বিদ্যুত্ হালদার বলেন, “ওই ২১৩ একর উর্বর চাষজমি বছরে তিন বার ধান চাষ ছাড়াও নানা সব্জির ফলন হয়। ওই জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ তো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জমি নীতির পরিপন্থী। তার চেয়ে বরং হিলি বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে সদর রাস্তার ধারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে কয়েকশো একর অনুর্বর জমিতেই স্থলবাণিজ্য বন্দর গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল।”
জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা আইনজীবী নীলাঞ্জন রায়ের অভিযোগ, “রাজ্য সরকারের সঠিক জমি নীতিটা কী সেটাই তো এখনও রাজ্যবাসীর কাছে বোধগম্য নয়। উত্তর দিনাজপুরের ক্ষেত্রে একরকম। আবার দক্ষিণ দিনাজপুরে অন্যরকম। এসব ভাঁওতা ছাড়া আর কিছু নয়।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক মানবেশ চৌধুরী অভিযোগ করেন, “এদের জমি নীতি বলে কিছু নেই, হিলিতে বাণিজ্য বন্দর গড়ার নামে জমি নিয়ে যা হচ্ছে। তা তৃণমূলের দেখনদারি ব্যাপার। কারণ, গত তিন বছরে তো রাজ্যে কিছুই হলো না।”