স্বপ্নপূরণের সাফল্য অনুভবের রূপে

বাড়ি থেকে মেলা দেখতে বেরিয়ে ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিল অঙ্কিতা। থানা-পুলিশ হয়ে শৈশব থেকেই হোমে। প্রতি বছর পুজোর সময়ে নিয়ম করে নতুন জামা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিয়মিত শ্যাম্পু করে চুলের যত্ন নেওয়ার অবকাশ ছিল না। কাছের এক আত্মীয়ের হাত ঘুরে এমন একটি বাড়িতে এসে উঠেছিল সায়রা। সেখানে নিয়মিত নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। সেখান থেকে উদ্ধার হয়ে হোমে এসে স্কুলে ভর্তি হয়।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০১:৪৪
Share:

বাড়ি থেকে মেলা দেখতে বেরিয়ে ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছিল অঙ্কিতা। থানা-পুলিশ হয়ে শৈশব থেকেই হোমে। প্রতি বছর পুজোর সময়ে নিয়ম করে নতুন জামা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিয়মিত শ্যাম্পু করে চুলের যত্ন নেওয়ার অবকাশ ছিল না।

Advertisement

কাছের এক আত্মীয়ের হাত ঘুরে এমন একটি বাড়িতে এসে উঠেছিল সায়রা। সেখানে নিয়মিত নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। সেখান থেকে উদ্ধার হয়ে হোমে এসে স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু তার বহু বছর পরেও সেই আত্মীয়ের কথা মনে আসায় যন্ত্রনা-অভিমানে চোখ জলে ভরে উঠত। চোখের জল মুছে আইলাইনার দিয়ে সেজে ওঠার ইচ্ছে হয়নি সায়রার।

বাড়ির অভাবে পরিচারিকার কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল বালিকা রোশনিকে। বাসাবাড়িতে মার খেয়ে বাড়ি ফিরে এক মদ্যপ আত্মীয়ের গলাধাক্কা খেতে হয়েছিল। হোমে আসার পরে বেশ কিছুদিন জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেই কেটে গিয়েছে। স্নানের পরে ছাড়া আয়নার সামনে দাঁড়ানোর অভ্যেস এখনও রোশনীর নেই।

Advertisement

অঙ্কিতা-সায়রা-রোশনীর নামগুলি কাল্পনিক হলেও, ঘটনাগুলি সত্যি। শৈশবকালের নানা ক্ষত যাদের জীবনে সাজগোজকে অপ্রয়োজনীয় করে রেখেছিল, তারাই এবার পুজোতে অন্যদের সাজিয়ে সাবলম্বী হতে চাইছে। জলপাইগুড়ির অনুভব হোম কর্তৃপক্ষ আবাসিকদের স্বনির্ভর করতে পার্লার খুলেছে। অনাথ ও ভবঘুরে বালিকাদের হোমে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে থাকা নিয়ে আইনি নানা জটিলতা রয়েছে। হোম থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে তাও অনেক আবাসিকের জানা থাকে না। ওদেরকেই আত্মনির্ভর করতে তৈরি হয়েছে বিউটি পার্লার।

শহরের রেসকোর্স পাড়ার অনুভব হোমের ১৮ জন তরুণীকে সরকারি পলিটেকনিক কলেজের একটি কেন্দ্র থেকে ‘বিউটিশিয়ানে’র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। আর চার তরুণীর নেওয়া বিএসকেপি ঋণের অর্থ দিয়ে সাজানো হয় পার্লার। এক শুভানুধ্যায়ী তাদের একটি ঘর পার্লার তৈরির জন্য ছেড়ে দিয়েছেন বলে হোম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। শুধু পার্লার নয়, স্বনির্ভর হতে ফাস্ট ফুডের স্টলও খুলতে চাইছেন তরুণীরা। তার মহড়া হিসেবে পার্লারের সামনে একটি ‘মোমো’র দোকানও খোলা হয়েছে। অনুভব হোমের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মহিলা কল্যাণ সমিতির সম্পাদিকা দীপশ্রী রায় বলেন, “মেয়েদের পাওয়া ঋণের সঙ্গে হোমের তরফেও কিছু অর্থ জোগাড় করা হয়েছিল। মেয়েদের স্বনির্ভর করতেই এই উদ্যোগ। পার্লার থেকে যা লাভ হবে তা মেয়েদের নামেই জমা হবে। ভবিষ্যতে পার্লারের পরিকাঠামো এবং প্রচার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

কেমন সেই বিউটি পার্লার?

স্বচ্ছ কাঁচের দেওয়ালের ওপারে ভারী পর্দা ঝুলছে। ভিতরে কয়েকটা প্রসাধণী বিজ্ঞাপনের পোস্টার। কাঠের তৈরি টেবিল, তাতে সদ্য পালিশের গন্ধ। দেওয়ালে ঝোলানো শো’কেসে সাজানো রয়েছে শ্যাম্পু, জেল, তেল, ক্রিমের হরেক রকম বোতল। কেতাদুরস্ত বিউটি পার্লারের মতো না হলেও, নুন্যতম যা প্রয়োজন সবই রয়েছে জলপাইগুড়ির ক্লাব রোডের ‘রূপ’-এ। গা এলিয়ে দিলে প্রায় সরলরেখায় চলে আসে এমন একটি চেয়ারও রয়েছে। ছোট্ট ঘরটির চার দেওয়ালে দস্তুর মতো লম্বা আয়নাও লাগানো হয়েছে। মহালয়ার আগেই বিউটি পার্লার চালু হয়েছে। যদিও শহরের বিভিন্ন এলাকায় তো দূরের কথা, পার্লারের সামনেও ঝাঁ চকচকে কোনও সাইনবোর্ড নেই। নেই প্রচারও। পার্লারের আসবাব আর প্রসাধণী কিনেই মূলধন শেষ হয়ে গিয়েছে চার তরুণীর। কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেই ওরাই হাসিমুখে স্বাগত জানাবেন। পার্লারের প্রচারের জন্য ‘লোকমুখে’র উপরেই আপাতত ওরা ভরসা রাখছে। হোমের সুপার ডালিয়া মিত্র বলেন, “শৈশব থেকে ওরা শুধুই স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয়েছে। এবার স্বপ্নপূরণে নিজেরাই উদ্যোগী হয়েছে। আমরা আমরা সাহায্য করছি মাত্র।”

পার্লারের নাম রাখা হয়েছে রূপ। সাইনবোর্ডে নামের নীচে ছোট হরফে লেখা, ‘সাজাব যতনে’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন