মুকুল রায়ের সঙ্গে গৌতম পাল। রবিবার রায়গঞ্জে তোলা নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেসের আট সদস্য অনাস্থা এনে বামফ্রন্ট পরিচালিত উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতিকে অপসারিত করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা এখনও কেউই তৃণমূলে যোগ দেননি। এই পরিস্থিতিতে বিদায়ী জেলা পরিষদের কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা পূর্ণেন্দু দে-কে জেলা পরিষদের সহকারি সভাধিপতি করার ইঙ্গিত দিয়ে রবিবার দলের নেতা কর্মীদের ‘ক্ষোভে’র মুখে পড়লেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়।
আজ, সোমবার জেলা পরিষদের নতুন সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি নির্বাচন করার জন্য জেলা পরিষদের ২৬ জন সদস্যকে বৈঠকে ডেকেছে জেলা প্রশাসন। নয়া সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি কে হবেন তা ঠিক করতে রবিবার রায়গঞ্জের সার্কিট হাউসে অনাস্থার পক্ষে থাকা বামফ্রন্ট, কংগ্রেস ও তৃণমূলের জেলা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুকুলবাবু। পাশাপাশি, জেলা তৃণমূলের নেতাদের নিয়েও আরেকটি বৈঠক করেন তিনি। তৃণমূলের অন্দরের খবর, মুকুলবাবুর উপস্থিতিতে প্রতিটি বৈঠকে গোয়ালপোখরের সিপিএম সদস্যা আলেমা নুরি ও করণদিঘির সিপিএম সদস্যা বিপাশা দাস সিংহের মধ্যে একজনকে সভাধিপতি করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।
দল সূত্রে খবর, এরপর মুকুলবাবুর কাছে তৃণমূলের নেতা কর্মী-সহ জেলা পরিষদের সদস্যরা ইটাহারের তৃণমূল সদস্য গৌতম পালকে সহকারি সভাধিপতি করার অনুরোধ করেন। কিন্তু মুকুলবাবু তাঁদেরকে কোনও আশ্বাস না দিয়ে পূর্ণেন্দুবাবুকে কংগ্রেসের সব সদস্যদের নিয়ে আজ, সোমবারের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি, গৌতমবাবুকে যে সহকারি সভাধিপতি করা হচ্ছে না, পরোক্ষে সেকথাও তৃণমূলের নেতা কর্মীদের বুঝিয়ে দেন। বৈঠকে উপস্থিত নেতাদের একাংশের দাবি মুকুলবাবু সেখানে বলেন, “গৌতমের বয়স অল্প। ওর এখনও অনেক সময় বাকি রয়েছে। তাই ধৈর্য্য ধরতে হবে ওকে।” এ কথা শোনার পরেই গৌতমবাবু-সহ তৃণমূলের নেতা কর্মীদের একটি বড় অংশ সার্কিট হাউস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বৈঠকের পরে মুকুলবাবু প্রকাশ্যে বলেন, “সভাধিপতি ও সহকারি সভাধিপতি নির্বাচন নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করব না। এতটুকু বলতে পারি এই প্রথম উত্তর দিনাজপুর জেলা পরিষদ পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে তৃণমূল।” তৃণমূল সূত্রের খবর, কংগ্রেসের সদস্যদের পাশাপাশি অনাস্থার পক্ষে থাকা বামফ্রন্ট সদস্যদেরও আজ, সোমবারের মধ্যে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুকুলবাবু।
দল সূত্রে খবর, গৌতমবাবু উদ্যোগেই বামফ্রন্টের ৬ ও কংগ্রেসের ৮ জন সদস্য তৃণমূলের ৫ জন সদস্যের সঙ্গে হাতমিলিয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর সিপিএমের সভাধিপতি লাডলি চৌধুরী ও আরএসপির সহকারি সভাধিপতি প্রফুল্লকুমার দেব সিংহের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন। তাঁদের অনাস্থার জেরে প্রশাসনিক উদ্যোগে আয়োজিত তলবি সভায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর সভাধিপতি ও ২৬ সেপ্টেম্বর সহকারি সভাধিপতি অপসারিত হন। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদের ২৬টি আসনের মধ্যে ১৩টি আসনে জয়ী হয়ে জেলা পরিষদের ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট। সিপিএম ১০টি, আরএসপি ২টি ও ফরওয়ার্ড ব্লক একটি আসন পায়। কংগ্রেস ৮টি ও তৃণমূলের ৫টি আসন দখল করে।
তবে দলের মধ্যেই যে গৌতমবাবুকে সহকারি সভাধিপতি করার দাবি উঠেছে তা মেনে নিয়েছেন একাধিক নেতা। জেলা তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি তথা দলের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক অসীম ঘোষ বলেন, “দলের স্বার্থেই আমরা মুকুলবাবুর কাছে সহকারি সভাধিপতির পদে গৌতমকে বসানোর অনুরোধ করেছি। কারণ, জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি হওয়ার সুবাদে গৌতম ভাল সংগঠক! ও সহকারি সভাধিপতি না হলে দলের কর্মী সর্মথকদের মধ্যে হতাশা বাড়বে।” জেলা তৃণমূলের কার্যনির্বাহী সভাপতি শেখর রায় বলেন, “আমরা বিষয়টি মুকুলবাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি!। আশা করব, দলের জেলা সভাপতি মুকুলবাবুর সঙ্গে কথা বলে উপযুক্ত পদক্ষেপ করবেন।” ইটাহারের আরেক তৃণমূলের জেলা পরিষদ সদস্য মোশারফ হোসেনের কথায়, “গৌতমবাবুকে সহকারি সভাধিপতি পদে বসানোর জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব।”
এই দাবিতে কার্যত সায় দিয়েছেন দলের জেলা সভাপতি অমল আচার্যও। গৌতমবাবুর নাম না করে তাঁর মন্তব্য, “আমরা চাই জেলা পরিষদের নির্ণায়ক শক্তি দলের হাতেই থাকুক।” তবে গৌতমবাবু অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি সহকারি সভাধিপতি হচ্ছেন না। তাঁর কথায়, “দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে পূর্ণেন্দুবাবুই সহকারি সভাধিপতি হবেন।” পূর্ণেন্দুবাবু জানান, তাঁরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “সহকারি সভাধিপতি পদে বসতে কোনও আপত্তি নেই।”
তৃণমূলের অন্দরের খবর, গত বছরের অগস্ট মাসে ইটাহারের ডক্টর মেঘনাদ সাহা কলেজের অধ্যক্ষা স্বপ্না মুখোপাধ্যায়-সহ কলেজের তিন শিক্ষক শিক্ষিকা ও এক শিক্ষাকর্মীকে নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে। প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্ত্রীকে নকল করতে বাধা দেওয়ায় ওই দিন গৌতমবাবু তাঁর অনুগামীদের নিয়ে তাঁদের উপর চড়াও হন বলে অভিযোগ। গৌতমবাবু ওই ঘটনায় অভিযুক্ত হওয়ার কারণে তাঁকে সহকারি সভাধিপতির পদে বসালে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে সমালোচনার মুখে পড়তে পারে দল। সে কারণেই গৌতমবাবুকে ওই পদে মনোনীত করা হয়নি বলে একাংশ নেতার ধারণা।
গৌতমবাবুর অবশ্য দাবি, “আমাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনও ভিডিও ফুটেজ নেই যে প্রমাণ হবে আমি কলেজে গিয়ে কাউকে নিগ্রহ করেছি। দলের কর্মী সমর্থকেরা আমাকেই সহকারি সভাধিপতি পদে চাইছেন। আশা করব, শীর্ষ নেতৃত্ব এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে ভবিষ্যতে জেলায় দলে ভাঙন বা ক্ষতি হবে।”