হেঁসেল সামলাতে দুর্গা গড়ছেন লক্ষ্মীরাও

যিনি রাঁধেন, তিনি মূর্তিও গড়েন। হেঁসেলের খরচ সামলাতে মায়ের মূর্তি গড়তে স্টুডিওতে এসেছেন ঘরের ‘লক্ষ্মী’রাও। দশভূজা দেবী দূর্গার সঙ্গে চার ছেলে-মেয়ে, তাঁদের বাহন, মহিষাসুর, সিংহ নিয়ে প্রতিমা আকারে-বহরে অনেক বড়। দেবী দূর্গার ছোট প্রতিমা তৈরির খরচও তুলনামুলক অনেকটাই বেশি। দূর্গা প্রতিমা তৈরির জন্য স্টুডিওতে অতিরিক্ত কারিগর-কর্মীও মজুরি দিয়ে রাখতে হয়।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০২:৫৭
Share:

কাজে মগ্ন (বাঁ দিকে) টুম্পাদেবী ও পুষ্পাদেবী। নিজস্ব চিত্র।

যিনি রাঁধেন, তিনি মূর্তিও গড়েন। হেঁসেলের খরচ সামলাতে মায়ের মূর্তি গড়তে স্টুডিওতে এসেছেন ঘরের ‘লক্ষ্মী’রাও। দশভূজা দেবী দুর্গার সঙ্গে চার ছেলে-মেয়ে, তাঁদের বাহন, মহিষাসুর, সিংহ নিয়ে প্রতিমা আকারে-বহরে অনেক বড়। দেবী দুর্গার ছোট প্রতিমা তৈরির খরচও তুলনামুলক অনেকটাই বেশি। দুর্গা প্রতিমা তৈরির জন্য স্টুডিওতে অতিরিক্ত কারিগর-কর্মীও মজুরি দিয়ে রাখতে হয়। তার জেরে মুনাফাও কমে যায় অনেকটাই। তার টান পড়ে শিল্পীর হেঁসেলেও। সেই টান সামাল দিতেই হেঁসেল থেকে স্টুডিওতে আসা টুম্পা পালের।
প্রায় দেড় দশক ধরে মূর্তি গড়েন টুম্পাদেবী। শিলিগুড়ির কুমোরটুলির একটি স্টুডিওতে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত কখনও হাতে মাটি মেখে, কখনও বা তুলিতে রং ভরিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ করেন। টুম্পাদেবী জানালেন, মূর্তি গড়ার কাজ মোটেই সহজ নয়। প্রথমে পোয়াল দিয়ে বাঁধা শিখতে হয়। এক একটা দড়ির একেকরকম প্যাঁচ। তারপরে মাটি লেপে, মাটি শুকনো, ফের একপ্রস্ত মাটির প্রলেপ, সব শেষে রং। এই সবকাজই টুম্পাদেবী করতে পারেন। যদিও ছোটবেলায় এসবের কোনও তালিম-ই তাঁর ছিল না। মূর্তি গড়ার কাজে কোনও আগ্রহও ছিল না, কৃষিজীবী পরিবারের মেয়ের। ইসলামপুরের বাসিন্দা টুম্পাদেবীর বাবা সম্পন্ন কৃষক। বাড়িতে বড় ধানের গোলা। ধান ঝাড়াই, মাড়াই, ধান শুকোনো করে বিক্রির নানা কাজ করতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। আশ্বিনের দুপুরে স্টুডিওতে বসেই স্মৃতি হাতড়ান টুম্পাদেবী। বিয়ে বয়েছিল এক ফাল্গুনে। স্বামী নামকর একজন মৃৎশিল্পী। বছর ঘুরে ভাদ্রমাস আসতেই টুম্পাদেবীও স্টুডিওতে ঢুকে পড়েন। সে বছরকে হাতেখড়ি ধরলে হাতেমাটি লাগার পনেরো বছর কেটে গিয়েছে তাঁর। বললেন, ‘‘মনে আছে প্রথম কয়েকদিন শুধু মূর্তি গড়ার কাজ দেখে গিয়েছি। প্রথম বছরটা বলতে গেলে, দেখতে দেখতেই চলে গিয়েছে। পরের বছর পোয়াল বাঁধতে শিখি, তারপর ধীরে ধীরে মাটির কাজ, রঙের কাজ শিখেছি।’’
এখন অবশ্য পাকা শিল্পী মিলনবাবুর ঘরনি টুম্পাদেবী। একটি ব্রাশে মাটির প্রলেপ লাগিয়ে অভ্যস্ত হাতে প্রতিমায় লাগাচ্ছেন। আবার কখনও হাত দিয়ে মাটিও মাখছেন। কখনও আবার নানা অনুপাতে রং মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করছেন। বললেন, ‘‘সকলে মিলে কাজ করতে হয়। সকলেই পোয়াল বাঁধি, সকলেই রং করি।’’ সকলে মানে তিনি, স্বামী মিলনবাবু এবং জনাতিনেক কারিগর। কেন হঠাঠ এ পেশায় আসা?

Advertisement

উত্তরের জন্য বিন্দুমাত্র সময় নিলেন না কৃষিজীবী পরিবারে বড় হওয়া টুম্পাদেবী বললেন, ‘‘আমি না কাজ করলে, আরও একজন কারিগর রাখতে হতো। তাকে দিন পিছু মজুরি দিতে হতো। সেই টাকাতো বেঁচে গেল। বাজারের যা দাম। সেই তুলনায় প্রতিমার দাম বাড়ালে পুজো উদ্যোক্তারা মেনে নেবেন না। তাই সংসারের খরচ বাঁচাতে মূর্তি গড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এখন বেশ লাগে।’’

দুপুরে স্বামী-সহ অন্য কারিগররা কখন খেতে যাবেন তাও ঠিক করে দেন টুম্পাদেবী। কুমোরটুলির রাস্তার দু’পাশে স্টুডিও। দু’তিন পা এগোতেই সুদেব পালের স্টুডিও। শেষ দুপুরে বাইরে বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন তিনি। ভিতরে পুষ্পাদেবী অবশ্য একমনে ছাঁচে মাটি ফেলে প্রতিমার গয়না তৈরি করছেন। তিনি বললেন, ‘‘আমি কিন্তু পোয়াল বাঁধতে পারি না। মাটির কাজও ভাল পারি না।’’ সুদেববাবু দাবি করেন, রঙের কাজ বা মাটির গয়না তৈরি করতে পুষ্পাদেবী বড় শিল্পীদের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে পারেন। পুষ্পা দেবীও মৃৎশিল্পী পরিবারের মেয়ে নন। তাঁর বাবার একটি দোকান রয়েছে সুভাষপল্লিতে। তিনিও বিয়ের পরে কাজ শিখেছেন। এবং এখন নিজেদের স্টুডিওতে অপরিহার্য।

Advertisement

টুম্পাদেবী বিকেলে স্টুডিও থেকে ফিরে আবার রান্না ঘরে ঢোকেন, দুই ছেলের পড়াশোনার তদারকি করে। সকালে রান্না সেরেই স্টুডিওতে আসেন। পুষ্পাদেবীও বাড়ির সকলের জন্য খাবার ঢেকে রেখে স্টুডিওতে আসেন। কে কখন খাচ্ছে মোবাইলে তার তদারকিও করেন। মিলনবাবু এবং সুদেববাবু দু’জনেই দাবি করেলন, তাঁদের স্ত্রীদের ছাড়া বাড়ির হেঁসেলও অচল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন