ধূপগুড়ির এই রেললাইনেই উদ্ধার হয় ছাত্রীর দেহ। —ফাইল চিত্র।
আলুর ফাটকা কারবার করে শহরের এর শ্রেণির মানুষ হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠায় ক্রমশ নষ্ট হতে বসেছে ধূপগুড়ির সমাজ সংহতি। পাল্টেছে ধূপগুড়ি ও লাগোয়া এলাকার সমাজ, গ্রামের আদল, বাসিন্দাদের মানসিকতা, পছন্দ, রুচি সবই। আর তার জেরেই বাড়ছে প্রতিযোগিতা, এমনটাই মনে করছেন জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান সুদীপ চক্রবর্তী।
তাঁর বক্তব্য, “এক শ্রেণির মানুষ রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠার অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তার আঘাত এসে পড়ছে ধূপগুড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গায়ে। সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।”
“আমরা আতঙ্কিত। আমাদের ছেলেমেয়েরা কেমন করে মানুষ হবে বলুন তো?”প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষক অমিত দে। তাঁর বক্তব্য, পুরনো দিনে শহরটা গরিব ছিল। হাওয়ায় এতত টাকার গন্ধ ভাসত না। অথচ নাটক, যাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত কত। শহরের পরিবেশটা অন্য রকম ছিল। আজ আর সেই ঐতিহ্য নেই।
বিনোদনের চরিত্র পাল্টে গিয়েছে। সৃষ্টিশীলতার পরিবর্তে উশৃঙ্খলতাই এখন বিনোদন। শহরের আনাচে কানাচে গজিয়েছে পানশালা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উশৃঙ্খলতা, অসামাজিক কাজকর্ম।
গত বছর সেপ্টেম্বরে এক ছাত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সংবাদ শিরোনামে চলে আসে এই শহরটা। সেই ঘটনার রেশ না কাটতে ডিসেম্বরে ফের গোঁসাইহাট এলাকায় সিম খেত থেকে উদ্ধার হয় এক তরুণীর দেহ।
সিপিএম কর্মী সঞ্জিত দে বলেন, কাঁচা টাকা হাতে আসার ফলে সমাজ জুড়ে আধিপত্য তৈরির মরিয়া চেষ্টা চলছে। সামাজিক নিয়ম এবং আইনের তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া ভাবে চলা এক শ্রেণির মানুষের প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়ছে।
প্রবীণ নাট্যকার অনিল অধিকারীর আক্ষেপ, “চোখের সামনে পাল্টে গেল শহরটা। এখন বড় নিষ্প্রাণ লাগে। যাঁরা আলুর কারবার করে লাভবান হচ্ছেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটুকু রক্ষা করায় তাঁদের কোনও মন নেই।”
অনিলবাবুর মতো লেখক পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্তও এখন এই শহরকে ‘মৃত’ বলে ভাবছেন। তাঁর কথায়, “মৃত শহরে কাঁচা টাকা আছে। প্রাণ নেই। তাই অপরাধ নিত্যসঙ্গী।”
কেন এমনটা হল? সরকারি কর্মী মৃন্ময় চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আগে এই শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ঐক্য ছিল। এখন বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। প্রতিটা পরিবারই এখন যেন পরস্পরের প্রতিযোগী।”
এর সঙ্গে একমত স্থানীয় তৃণমূল নেতা গুড্ডু সিংহও। জলপাইগুড়ি-গয়েরকাটা রোডের পাশে নিজের গোছানো ছোট্ট অফিসে বসে খোলাখুলি বলছেন তিনি, “জটিল সঙ্কটের মধ্যে ধূপগুড়ি চলছে। এই বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না।”
জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের মনোরোগবিশেষজ্ঞ স্বস্তিশোভন চৌধুরীর বক্তব্য, আলুর ফাটকা কারবারকে কেন্দ্র ধূপগুড়িতে নতুন ধনীদের নতুন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আর এক দিকে রয়েছে, বাসিন্দাদের অন্য একটা অংশ, যাঁদের রোজগার নির্দিষ্ট। হঠাৎ ফুলেফেঁপে ওঠার সুযোগ নেই। তাঁদের যে সংস্কৃতি, তা শহরের ঐতিহ্যকে বহন করলেও অনেকটাই দুর্বল। তিনি বলেন, “এই দুই সংস্কৃতির মধ্যে সংঘাত বেড়েছে।
কেপিপি নেতা সুবল রায় জানান, আলুর দাম তলানিতে ঠেকলে ধূপগুড়িতে আত্মহত্যা বাড়ে।
বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ২০০৩ সালেও এমনটাই হয়েছিল। স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই বছর আলুর দাম হঠাৎ অনেকটাই নেমে যাওয়ায় কীটনাশক খেয়ে অসুস্থ হয়ে ১২০ জন ধূপগুড়ি ব্লক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০ জনে। ফসলের দাম না পেয়ে মার্চ-এপ্রিল মাস থেকে ফের আত্মহত্যা বাড়ে। এক দশক পরে ফের আলুর দর নামছে দেখে উদ্বিগ্ন প্রাক্তন মন্ত্রী বনমালী রায়। বলেন, “খুব খারাপ সময় চলছে। জানি না শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে!”
সহমত স্বস্তিশোভনবাবুও। তিনি বলছেন, “ইতিমধ্যে শহরে মনোরোগ, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। এটাও এই সামাজিক অস্থিরতাপ্রসূত।”
(শেষ)