খাতায় বেআইনি, তবু আয়ারা বহাল তবিয়তে

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ অপেক্ষার পরে রোগী ভর্তি হতে পারেন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া মিটতেই ওয়ার্ডের ভিতরে, রোগীর পরিজনেদের কাছে হাজির হয়ে যান কয়েক জন মহিলা। রোগীর পরিবারকে জানানো হয়, তাঁরা হাসপাতালের আয়া।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৪০
Share:

একটি সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ড। ফাইল চিত্র

সরকারি নথিতে ওঁদের কোনও অস্তিত্ব নেই। অথচ হাসপাতালের মূল ফটক থেকে শুরু করে রোগীর শয্যার পাশে পর্যন্ত ওঁরা উপস্থিত। এমনকি, মাঝেমধ্যে ওঁদের দৌরাত্ম্যে নাজেহাল হয়ে পুলিশেরও দ্বারস্থ হন ভুক্তভোগীরা! ওঁরা সরকারি হাসপাতালের আয়া।

Advertisement

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারি হাসপাতালে দীর্ঘ অপেক্ষার পরে রোগী ভর্তি হতে পারেন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া মিটতেই ওয়ার্ডের ভিতরে, রোগীর পরিজনেদের কাছে হাজির হয়ে যান কয়েক জন মহিলা। রোগীর পরিবারকে জানানো হয়, তাঁরা হাসপাতালের আয়া। রোগীকে দেখভালের জন্য দু’টি শিফটে দু’জন আয়াকে ‘রাখতে’ হবে। কোথাও ১২ ঘণ্টার জন্য আড়াইশো, কোথাও আবার দিতে হবে ৩০০ টাকা। হুমকির সুরে আরও বলে দেওয়া হয়, আয়া না রাখলে সময় মতো খাবার বা ওষুধ জুটবে না রোগীর। এমনকি তাঁর শারীরিক অবস্থা কেমন, তা-ও জানতে পারবেন না বাড়ির লোক।

সরকারি হাসপাতালে এ ভাবেই আয়ার দাপটের অভিযোগ তোলেন রোগী ও আত্মীয়েরা। মঙ্গলবার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ঘটনা সেই দুর্ভোগকেই আবার সামনে এনেছে। অভিযোগ, স্ত্রী-রোগ বিভাগে ভর্তি থাকা মা ও সদ্যোজাতের খবর দেওয়ার জন্য ৭০০ এবং ৫০০ টাকা চেয়েছিলেন দুই আয়া। প্রথমে টাকা দিয়ে দিলেও পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন রোগীর পরিজনেরা। তার ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় ওই দুই আয়াকে।

Advertisement

এই প্রথম নয়। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আগেও একাধিক বার আয়ার দৌরাত্ম্যের অভিযোগ উঠেছে। সমস্যা সমাধানে সম্প্রতি চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বারবার বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, তার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি।

এই ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। যে কোনও সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় পরিষেবা পাওয়া গেলেও রোগীর খাবার বা তাঁকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিনপ্রতি প্রায় ছ’শো টাকা খরচ করতে হয়।

রোগীর পরিবারের একটা ব়ড় অংশের অভিযোগ, হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের একাংশ আয়া রাখার জন্য পরিবারকে ‘চাপ’ দেন। আয়া না থাকলে রোগীর জন্য বরাদ্দ খাবার থেকে ওষুধ, কিছুই পৌঁছয় না। আরও অভিযোগ, অতিরিক্ত টাকা খরচ করেও সমস্যা মেটে না। দিনে একাধিক বার শৌচাগারে নিয়ে যাওয়ার আর্জি জানালে আয়ার বিরুদ্ধে রোগী-নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে। তা ছাড়া রোগী কথা বলতে অসমর্থ হলে কোনও দেখভাল হয় না।

স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য জানাচ্ছে, সরকারি হাসপাতালে আয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। রোগীর দেখভালের জন্য নার্স আছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হাসপাতালের নিরাপত্তা বা সাফাইয়ের কাজে যুক্ত কর্মীরা ‘আয়া-চক্র’ চালান। রোগীর পরিজন পরিচয়ে থাকেন ওয়ার্ডেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়রানির আশঙ্কা করে রোগীর পরিবারও লিখিত অভিযোগ করে না।

বেসরকারি এক সংস্থার সঙ্গে যুগ্ম ভাবে এসএসকেএমে অবশ্য একটি প্রকল্প রয়েছে। সেখানে দিনে আড়াইশো টাকা দিয়ে রোগীর পরিবার নির্দিষ্ট অফিস থেকে আয়া নিতে পারে। যদিও সেখানেও দৌরাত্ম্য কম নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আয়া রাখার জন্য পরিবারকে বাধ্য করা হয়।

স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, এই সমস্যা মেটাতে স্টাফ নার্সের ঘাটতি পূরণ করা জরুরি। তাঁদের অন্যতম কাজই হল সময় মতো রোগীকে ওষুধ ও খাবার দেওয়া। কিন্তু রাজ্যে স্টাফ নার্সের ঘাটতি প্রায় সাড়ে ছ’হাজার। ফলে অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে বার্ন অথবা সার্জারি বিভাগে রোগীর মলম লাগানো কিংবা ব্যান্ডেজ করার মতো কাজও করছেন আয়ারা।

এর পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ রয়েছে, হাসপাতালের কোনও কর্মীর বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠলে দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘কড়া পদক্ষেপ করলেই জোর-জুলুমের সাহস হবে না। তবে, রোগীর পরিবারকেও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে অভিযোগ করতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন