এক শ্রেণির বেসরকারি হাসপাতাল কী ভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিল করছে, এমনকী মন্ত্রী-বিধায়কদেরও তোয়াক্কা করছে না, তা সম্প্রতি তিনিই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে এনেছিলেন। এ বার মন্ত্রী-বিধায়কদের চিকিৎসার জন্য লাগামহীন খরচেও রাশ টানার উদ্যোগ নিলেন বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধায়কদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বিধানসভার ‘এন্টাইটেলমেন্ট কমিটি’র বৈঠক ডেকে বিমানবাবু এক প্রকার এ-ও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, মন্ত্রী-বিধায়কদের নানা রকম রোগের চিকিৎসা পিছু প্যাকেজের অঙ্কও এ বার বেঁধে দেবে বিধানসভা।
বিধায়কদের চিকিৎসার খরচ বহন করে রাজ্য সরকার। চিকিৎসার খরচ প্রথমে মন্ত্রী বা বিধায়করা মিটিয়ে দেন। তার পর বিধানসভায় ওই বিল পেশ করলে সরকার তাঁদের সেই টাকা পরিশোধ করে। বর্তমানে ওই খরচের কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। কোনও মন্ত্রী বা বিধায়ক তাঁর চিকিৎসা বাবদ যে কোনও পরিমাণ খরচ করতে পারেন। ফলে প্রতি বছরই বিধায়ক-মন্ত্রীদের চিকিৎসার খরচ বাবদ বিপুল টাকা গুনতে হয় সরকারকে। এমনকী বিধায়কদের জমা দেওয়া বিলে বহু ‘অসামঞ্জস্য’ থাকা সত্ত্বেও অতীতে সেই বিল মেটাতে হয়েছে সরকারকে। কিছু বিধায়কের চিকিৎসা বিলে এমনই কিছু অসামঞ্জস্য খতিয়ে দেখা থেকেই বেসরকারি হাসপাতালগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি নিয়ে ভাবা শুরু স্পিকারের। এ বার সেখানেই থেমে না থেকে বিমানবাবুর নেতৃত্বে বিধানসভার ‘এনটাইটেলমেন্ট কমিটি’ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোনও মন্ত্রী বা বিধায়ক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করালে বেড ভাড়া বাবদ দৈনিক ৮ হাজার টাকার বেশি দেবে না সরকার।
ব্যক্তিগত ভাবে বিমানবাবু বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে স্বচ্ছন্দ নন। সরকারি পরিষেবাতেই সন্তুষ্ট। কিন্তু ইদানীং মন্ত্রী-বিধায়কদের সব চিকিৎসা-বিল মেটাতে গিয়ে দেখেছেন, তাঁরা সচরাচর কেউই সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন না। এসএসকেএম-এর মতো সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতালে সব রকম সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা বেসরকারি হাসপাতালেই যাচ্ছেন। এবং দেখা যাচ্ছে কেউ কেউ দৈনিক ২৫ হাজার টাকা ভাড়ার বেডেও ভর্তি হচ্ছেন। কেউ বা থাকছেন দৈনিক ১৫ থেকে বিশ হাজার টাকা ভাড়ার বেডে!
বিধানসভার ‘এন্টাইটেলমেন্ট কমিটি’র এক সদস্য এ দিন বলেন, ‘‘কেন অত বেশি ভাড়ার বেডে রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলির কাছে তা জানতে চাওয়া হয়। বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জবাব, ওই বিধায়কেরা নিজেরাই ওই ধরনের বেড বেছেছেন। এ কথা শুনেই দৈনিক বেড ভাড়ার ঊর্ধ্বসীমা ৮ হাজার টাকায় বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্পিকার।’’ কমিটির ওই সদস্যের কথায়, ‘‘এর পর ইচ্ছে হলে কোনও বিধায়ক বেসরকারি হাসপাতালের বিলাসবহুল সুইটে ভর্তি হতেই পারেন। কিন্তু ৮ হাজার টাকার বেশি ভাড়া হলে তা বিধায়ককে নিজের পকেট থেকেই মেটাতে হবে।
সূত্রের খবর, শুধু বেড-ভাড়ার সীমা বেঁধেই বল্গাহীন খরচ কমানো যাবে বলে মনে করেন না স্পিকার। তাই মন্ত্রী, বিধায়কদের সরকারি হেল্থ-স্কিমের আওতায় আনার প্রস্তাব দিতে পারেন তিনি। সে ক্ষেত্রে রোগ-ভিত্তিক চিকিৎসার খরচের সীমা বেঁধে দিতে চাইছে এনটাইটেলমেন্ট কমিটি। অর্থাৎ হার্টের বাইপাস সার্জারি, ডায়ালিসিস, অ্যানজিওগ্রাম, অ্যানজিওপ্লাস্টির মতো চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট খরচের সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। তার অতিরিক্ত সরকার দেবে না।
প্রসঙ্গত, বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ বিধায়করা কী ভাবে নিয়েছেন, তার নজির বিধানসভার খাতায় কম নেই। এমনকী চশমা বানানোর জন্য লক্ষাধিক টাকার বিলও ধরিয়েছেন বেশ কিছু বিধায়ক। মুখ্যমন্ত্রী স্পিকারকে পরামর্শ দিয়েছেন, অতীতে যা হয়েছে, হয়েছে। আর নয়। তার পর কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, চশমা খাতে কোনও মন্ত্রী বা বিধায়ককে পাঁচ হাজার টাকার এক পয়সাও বেশি দেওয়া হবে না।
বিধানসভা সূত্রে বলা হচ্ছে, আগামী মাসে কমিটির পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা। ওই বৈঠকের পর এই সব প্রস্তাব চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠাবে বিধানসভা।