অসময়ের ফুলকপিই ‘হিট’ বাঙালির পাতে

ঘটনা ১: আষাঢ়ের এক দিনে পুজোর ভোগে খিচুড়ি-বেগুনভাজা-লাবড়া। মেনুতে বিশেষ কিছু নেই। চমক খিচুড়ি ও লাবড়ার উপকরণে। দু’জায়গাতেই ফুলকপির রীতিমতো দাপুটে উপস্থিতি। ভক্তরা অবাক।

Advertisement

দেবাশিস দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৬ ০৮:৩৯
Share:

বিকিকিনি। শনিবার শিয়ালদহের বাজারে।—নিজস্ব চিত্র

ঘটনা ১: আষাঢ়ের এক দিনে পুজোর ভোগে খিচুড়ি-বেগুনভাজা-লাবড়া। মেনুতে বিশেষ কিছু নেই। চমক খিচুড়ি ও লাবড়ার উপকরণে। দু’জায়গাতেই ফুলকপির রীতিমতো দাপুটে উপস্থিতি। ভক্তরা অবাক।

Advertisement

ঘটনা ২: প্রৌঢ় গৃহকর্তা বউমার উপর ভারী খুশি। সন্ধ্যা গড়াতে না গড়াতে ফুলকো লুচি আর তরকারি। তবে একঘেয়ে আলুর ছেঁচকি না, আলু-ফুলকপির চচ্চড়ি!

ফুলকপি? এখন? এই অসময়ে? হ্যাঁ, এই অসময়েও দেদারে মিলছে ফুলকপি। এবং কিনতে গিয়ে দাম শুনে হাতে ছ্যাঁকাও লাগছে না!

Advertisement

আর তাই এখন ফুলকপিকে কেবল ডালনা-ঘণ্ট-চচ্চড়ি-ছেঁচকির অলঙ্কার নয়, প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার সাহস পাচ্ছেন গৃহস্থ বাঙালি। অন্যান্য বছর এই সময়ে বৃষ্টি পড়লে আলু-টোম্যাটো দিয়েই খিচুড়ি হয়। কিন্তু এ বার অন্য রকম। খিচুড়ি হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে ফ্রিজ খুলে যদি দেখা যায় ভেজিটেবল ট্রে ফুলকপিহীন, তবে সঙ্গে সঙ্গে বাজারে ছোটা।

পছন্দ মতো, কলঙ্কহীন কপি কুড়ি টাকায় মিলছে। খুব বেশি হলে পঁচিশ টাকা দর হাঁকছেন সব্জি বিক্রেতা। সব চেয়ে বড় কথা, সেই কপি দেখলে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসেও কিনতে ইচ্ছে করছে। দেখেই মনে হচ্ছে, এই কপি বিস্বাদ হবে না। সব্জি বিক্রেতারা দ্বিধাহীন কণ্ঠে জানাচ্ছেন, এই ফুলকপি রাঁচির নয়, খাস বাংলার।

আগে গ্রীষ্ম বা বর্ষায় ফুলকপির দরকার হলে বাংলাকে তাকিয়ে থাকতে হতো ঝাড়খণ্ডের দিকে। সেই ফুলকপি দর্শনধারী তো হতোই না, গুণও পাতে দেওয়ার পক্ষে অযোগ্য ছিল। এক-একটির দাম চড়ত পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত।

কিন্তু এ বার অসময়ে ফুলকপি সহজলভ্য হওয়ার রহস্য কী? রহস্য লুকিয়ে অনুরাধা, বরখা, ইস্টওয়েস্ট, গিরিজা, হানসা, কবিতা, মেঘার মধ্যে। এগুলো সবই বীজের নাম। ফুলকপির বীজ।

কল্যাণীর বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এখন যে ধরনের ফুলকপির বীজ পাওয়া যায়, তাতে সারা বছরই চাষ করা যায়। এই চাষের জন্য শুধু সেচের ব্যবস্থা ঠিকঠাক রাখতে হয়। আর শীতের ফুলকপির তুলনায় এই কপিতে সারও লাগে বেশি (যে কারণে বহু বিক্রেতাই এই কপির পাতা খেতে বারণ করেন)।

বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব্জি গবেষক অরূপ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘ফুলকপির এই সব বীজ ২৬ ডিগ্রি থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। তাই চাষে কোনও অসুবিধা হয় না।’’ আর এক কৃষি গবেষক হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শীতের মতো বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হয় না ঠিকই। তবে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদিয়া এবং হুগলির কয়েকটি এলাকায় এই সব বীজ নিয়ে চাষিরা যে ফুলকপির চাষ করছেন, সেটাই এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।’’

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বোড়ালের কৃষক বাপি বড়ালের বক্তব্য ‘‘গত দু’বছর গরমে ফুলকপি বেচে দশ হাজার টাকা লাভ করেছি। এই বছরের হিসেব এখনও হয়ে ওঠেনি। বেশিই হওয়া উচিত।’’ আর এই বছর বাপিবাবুদের সংখ্যাও বেড়েছে। বহু কৃষক গরমে কপি চাষ করছেন।

তবে শীতের কপির সঙ্গে আকারে গরমের কপির কিছুটা তফাত আছে। গরমের কপির এক-একটির ওজন ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম। শীতের কপি সেখানে এক কেজিরও বেশি হয়।

ফারাক আছে স্বাদেও। শীতের কপি স্বাদে-গন্ধে অনেকটাই এগিয়ে। ডুমো ডুমো করে কাটা আলুর সঙ্গে কালোজিরে দিয়ে ভাজা শীতের কপি কিংবা বড় বড় করে কাটা ফুলকপি দিয়ে কইমাছের ঝোল— সেই স্বাদ গরমের কপিতে মিলবে না। গরমের কপি সিদ্ধ করতেও সময় লাগে বেশি। তাই কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, শীতকালের সঙ্গে যে সব্জি এক রকম সমার্থক, সেই ফুলকপির চাষ গরমে করার দরকারই বা কী?

গরমে কপি ফলিয়ে খাওয়া তো এক হিসেবে তার চরিত্র হনন হচ্ছে। এর বিরুদ্ধ মত হল, এখন টোম্যাটো-ধনেপাতা-বিন-গাজর-বাঁধাকপি সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে। লোকে খাচ্ছেও। তা হলে শুধু ফুলকপি ব্রাত্য হয়ে থাকবে কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন