২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, মেদিনীপুরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মা বলে সম্বোধন করেন ভারতী ঘোষ (বাঁ দিকে)। আর ৪ জানুয়ারি, ২০১৯, নয়াদিল্লিতে বিজেপিতে যোগ দিয়েই মমতাকে কটাক্ষ তাঁর। —ফাইল চিত্র/ নিজস্ব চিত্র।
সময়টা প্রায় ঘাড়ে ঘাড়ে। মেট্রো চ্যানেলের ধর্না মঞ্চের পাশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশ পদক পরিয়ে দিচ্ছে কৃতী অফিসার, কর্মীদের। প্রায় তখনই নয়া দিল্লিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপি-তে যোগ দিলেন ভারতী ঘোষ, এক সময়ের মমতার অন্যতম ঘনিষ্ঠ আইপিএস!
তৃণমূল বহুদিনই ভারতী ঘোষের পর হয়েছে। তবে এই সময়কালের মধ্যে বারবার অডিয়ো বার্তায় সিআইডি ও রাজ্য পুলিশকে বিঁধলেও মমতার বিরুদ্ধে সে ভাবে মুখ খুলতে দেখা যায়নি ভারতীকে। এ দিন বিজেপিতে যোগদানের পরে অবশ্য তিনি বিঁধেছেন তৃণমূল নেত্রীকে। ধর্না কর্মসূচি নিয়ে খোঁচা দিয়ে বলেছেন, ‘‘অসত্যাগ্রহ হচ্ছে এক পুলিশ কমিশনারের জন্য, তদন্ত আটকানোর জন্য।’’
তবে একসময়ের খাসতালুক পশ্চিম মেদিনীপুর-ঝাড়গ্রামের রাজনৈতিক বৃত্তে প্রাক্তন আইপিএসের নামটা যে হারিয়ে যায়নি, তা তিনি রাজনীতি আসতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভারতীর বিজেপিতে যোগদানের কথা জেনে তৃণমূলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সভাপতি অজিত মাইতির প্রতিক্রিয়া, ‘‘আজ জেলার এক কালো দিন। সোনা চোর, বালি চোর বিজেপিতে যাবে, এটাই তো প্রত্যাশিত!’’ বিজেপির জেলা সভাপতি শমিত দাশের পাল্টা মন্তব্য, ‘‘বিজেপি উদার মনের পরিবার। সবাইকে হজম করতে পারে।’’
২০১৩ থেকে ২০১৭— পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ছিলেন ভারতী। তার আগে সামলেছেন ঝাড়গ্রামের পুলিশ সুপারের দায়িত্বও। গোটা পর্বেই জঙ্গলমহলে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন তিনি। শাসক দল তৃণমূলের ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, বলা ভাল ‘নেত্রী’ স্থানীয়। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা, বিশেষ করে জঙ্গলমহলের খুঁটিনাটি বিষয়ে ভারতীর উপর মমতার আস্থা ওই কালপর্বে বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। সরকারি মঞ্চে একাধিকবার মমতাকে ‘জঙ্গলমহলের মা’ বলে সম্বোধন করেছেন ভারতী। পাল্টা প্রশংসা ফিরিয়ে মমতা বলেছেন, ‘ভারতী অ্যাঙ্কর হিসেবেও ভাল কাজ করেছে। পুলিশে কাজ করলেও অ্যাঙ্কর হওয়া যায়। সব কাজ সবাই করতে পারে। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।’
ভারতীর আধিপত্য বরাবরই প্রশাসনিক কাজের সীমারেখা ছাপিয়ে শাসক বৃত্তে ঢুকেছে। তা নিয়ে বিতর্কও বেধেছে বারবার। ২০১৪-র লোকসভা এবং ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের সময় নির্বাচন কমিশন তাঁকে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব থেকে সরিয়েছে। তবে পঞ্চায়েত হোক পুরসভার ভোট, ভারতী তৃণমূলের হয়ে কাজ করছেন বলে সরব হয়েছে বিরোধীরা। সেই ভারতীই এখন বিরোধী দলে!
লোকসভা ভোটের আগে এই পদক্ষেপে জেলায় কি বিজেপি-র কিছুটা সুবিধা হবে? বিজেপি-র জেলা সভাপতির জবাব, ‘‘উনি ভুল শুধরে আমাদের দলে এসেছেন। এতে জেলায় আমাদের অবস্থান আরও মজবুত হবে।’’ যদিও জেলা তৃণমূল সভাপতির মত, ‘‘জেলায় বিজেপির যেটুকু ছিল, সেটুকুও আর থাকবে না। কথায় আছে না, বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ। এটা তেমনই হল।’’ ভারতী অবশ্য এ দিন লোকসভা ভোটে প্রার্থী হওয়া নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু জানাননি।
তৃণমূলের সঙ্গে বিরোধের পরপরই জেলা পুলিশ সুপারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ভারতীকে। সোনা-প্রতারণায় নাম জড়ায় তাঁর। গ্রেফতার করা হয় তাঁর স্বামীকে। ভারতীকে গ্রেফতারের জন্যও ‘লুক আউট’ নোটিস জারি করতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানিয়েছিল সিআইডি। পরে এক সময়ে পুলিশ মহলে এই জল্পনাও ছড়িয়েছিল যে রাজ্য সরকারের সঙ্গে ভারতীর ‘সন্ধি’ হয়ে গিয়েছে। ভারতী অবশ্য গা ঢাকা দিয়ে থেকেও বারবার অডিয়ো বার্তায় বিস্ফোরক সব অভিযোগ এনেছেন, সিআইডি-কে তুলোধনা করেছেন।
অজ্ঞাতবাস শেষ। তবে কি এ বার রাজনীতিক ভারতী ফের জেলায় ফিরবেন? জঙ্গলমহল জুড়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। প্রশাসনের অন্দরেই কেউ কেউ বলছেন, ‘‘ওঁর নামটা ভারতী ঘোষ। বাঘে-গরুকে এক ঘাটে জল খাওয়াতে পারেন উনি। ফলে কী যে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না!’’
বিজেপিতেও কি ভারতীর পুরনো ‘দাপট’ দেখা যাবে? বিজেপির জেলা সভাপতি শমিতের জবাব, ‘‘তৃণমূলের সঙ্গে আমাদের অনেক ফারাক। আমাদের দলে ছাঁকনি আছে। হয় এখানে এসে পুরো বিজেপি হয়ে যেতে হবে, না হয় সাইড লাইনে থাকতে হবে। মাঝামাঝি কিছু নেই।’’
ভোটের মাঠে কোন পজিশন তিনি নেন, সে দিকেই তাকিয়ে জঙ্গলমহলের জেলা!