বছর ঘুরলেও দিশাহীন খাগড়াগড় তদন্ত, অধরা ৪ চাঁই

নামেই ঘোল খাইয়েছে কওসর

হাজার হাজার ডক্টর হাজরা। আর এক ডজন কওসর! ‘সোনার কেল্লা’র নকল ‘ডক্টর হাজরা’ যেমন গোলমেলে, খাগড়াগড় কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত কওসর শেখ তার চেয়ে কিছু কম যায় না। কিন্তু জট বেশি পেকেছে নামের ধন্দে।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০৬
Share:

হাজার হাজার ডক্টর হাজরা। আর এক ডজন কওসর!

Advertisement

‘সোনার কেল্লা’র নকল ‘ডক্টর হাজরা’ যেমন গোলমেলে, খাগড়াগড় কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত কওসর শেখ তার চেয়ে কিছু কম যায় না। কিন্তু জট বেশি পেকেছে নামের ধন্দে।

একই নামের সুবাদে বহু সময়েই যে নিরপরাধ লোকজনের মধ্যে দাগি অপরাধী লুকিয়ে থাকে, কে না জানে! কিন্তু নামের পিছনে ধাওয়া করার কী জ্বালা, তা এনআইএ গত এক বছরে হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ নিয়ে তদন্তে নামা ইস্তক তাদের হাতে এসেছে এক ডজন কওসর, যাদের এক জনও সেই কুখ্যাত লোকটি নয়!

Advertisement

গত বছর ২ অক্টোবর দুপুরে বর্ধমানের বিস্ফোরণস্থলেই যার নাম শোনা গিয়েছিল, সে কওসর। আগের দিন হাসান চৌধুরীর বাড়িতে এসে শাকিল-রাজিয়াদের কাছ থেকে ব্যাগ ভর্তি করে দেশি গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিল যে যুবক। এনআইএ-র গোয়েন্দারা পরে বোঝেন, সে আসলে বাংলাদেশি নাগরিক, জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (‌জেএমবি)-র চাঁই এবং সে দেশে ‘বোমারু মিজান’ নামে কুখ্যাত।

কিন্তু সেই জঙ্গির সন্ধানে নামার পরে গত বছর ১০ অক্টোবর থেকে তদন্তকারীদের হাতে এক-এক করে চলে এসেছে বারো জন কওসর। কেউ পশ্চিমবঙ্গ, কেউ ওড়িশা, কেউ বা কেরল থেকে ধরা পড়া। এক জনও অবশ্য খাগড়াগড় কাণ্ডের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ কওসর নয়, যাকে ধরার জন্য দশ লক্ষ টাকা ইনাম ঘোষণা করেছে এনআইএ। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘কওসর নামটা শুনে প্রতি বারই আশার আলো দেখেছিলাম আমরা। কিন্তু নকল কওসরদের পিছনে সময় নষ্ট করে মাঝখান থেকে আসল কওসর যে কোথায় গা ঢাকা দিল, কে জানে!’’

কওসর একা নয়। খাগড়াগড় কাণ্ডে অভিযুক্ত আরও অন্তত ন’জন পলাতক। এদের মধ্যে কওসর ছাড়াও আরও তিন জন— তালহা শেখ, হাতকাটা নাসিরুল্লা ওরফে সোহেল ও মহম্মদ ইউসুফ জেএমবি-র চাঁই বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। ইউসুফ বাদে বাকিরা বাংলাদেশি। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই খবর দিতে পারলে দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। বছর ঘুরলেও খোঁজ মেলেনি।

তবে এনআইএ কর্তারা একে ‘ব্যর্থতা’ বলতে নারাজ। এনআইএ-র আইজি সঞ্জীব সিংহের দাবি, ‘‘গত এক বছরে এ দেশে জেএমবি-র সংগঠন গুঁড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে, বহু সদস্য-সমর্থক নিষ্ক্রিয় হয়েছে। এখানে হামলা করার ক্ষমতা ওদের নেই। এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।’’ অভিযুক্ত ৩২ জনের মধ্যে ২৩ জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

বাকিদের ধরা যাচ্ছে না কেন?

এনআইএ গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, সকলের গতিবিধি এখনও স্পষ্ট নয়। তবে কয়েক জনের খবর মিলছে। যেমন, বর্ধমানেরই মঙ্গলকোটে কৃষ্ণবাটী গ্রামের মহম্মদ ইউসুফ যে সস্ত্রীক কেরলে গিয়েছেন সেটা তাঁরা জানেন। ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে জেএমবি-র বড় পান্ডা এই ইউসুফই। মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ায় যে মাদ্রাসায় সংগঠনটির জঙ্গি প্রশিক্ষণের কেন্দ্র ছিল, যেখানে মহিলাদেরও জেহাদি মতবাদে দীক্ষিত করা হত এবং আগ্নেয়াস্ত্রের তালিম দেওয়া হত, সেটির প্রতিষ্ঠাতা তথা পরিচালক সে-ই। তার স্ত্রী-ই ছিল মহিলাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে।

ইউসুফ যদি কেরলেই থেকে থাকে, তাকে ধরতে বাধা কোথায়?

এনআইএ-র এক অফিসারের দাবি, বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদ থেকে কেরলে শ্রমিক-মজুর পাঠানোই ছিল ইউসুফের পেশা। সেই সুবাদে এই রাজ্য থেকে কাজ করতে যাওয়া কিছু শ্রমিক তাঁকে আশ্রয় দিয়েছেন বলে খবর রয়েছে। গত ১৮ জুন হাওড়া স্টেশনের কাছ থেকে ধরা পড়ে নুরুল হক ওরফে নইম নামে মুর্শিদাবাদের ডোমকলের এক জেএমবি-প্রশিক্ষিত জঙ্গি। কিছু দিন কেরলে আত্মগোপন করে ছিল সে-ও। সস্ত্রীক ইউসুফের সেখানে লুকিয়ে থাকার কথা জেরায় সে জানিয়েছে। কিন্তু ওই শ্রমিকদের ডেরা থেকে ইউসুফকে খুঁজে বার করা কার্যত খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার সামিল বলে গোয়েন্দাদের দাবি।

এই রাজ্যে জেএমবি-র সংগঠন গড়তে বাংলাদেশ থেকে যে প্রথম চাঁই এসেছিল বলে গোয়েন্দাদের ধারণা, সেই হাতকাটা নাসিরুল্লা ওরফে সুহেলও অধরা। এনআইএ-কে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে শুধু তার ল্যাপটপ নিয়ে। তদন্তকারীদের মতে, নাসিরুল্লা যে শুধু মুর্শিদাবাদেই ডেরা বাঁধেনি, তার প্রমাণ ওই ল্যাপটপ। কারণ, বীরভূমের নলহাটি এলাকার কুশ মোড় থেকে সেটি পাওয়া গিয়েছিল।

তবে এনআইএ সবচেয়ে আশাহত হয় তালহা শেখের নাগাল না পেয়ে। ২৭ জুলাই ঢাকায় জেএমবি-র আরও সাত জন পান্ডার সঙ্গে পাখি ওরফে তালহা নামে যে জঙ্গি ধরা পড়েছিল, সে-ই খাগড়াগড়ে অভিযুক্ত তালহা বলে গোয়েন্দারা ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু অগস্টে এনআইএ-র একটি দল ঢাকায় গিয়ে জানতে পারেন, এই তালহা আদৌ সেই তালহা নয়। তত দিনে ওই তালহার পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। ঢাকা পুলিশের কাছে তার ছবি দেখে এনআইএ-র গোয়েন্দাদের ভুল ভাঙে।

এনআইএ-র এক কর্তার বক্তব্য, জেএমবি-র পলাতক চাঁইদের ধরতে পারলে কিছু ধাঁধার উত্তর মিলতে পারে। তাঁর কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে আল কায়দার শাখা সংগঠন হিসেবে প্রথমে কাজ শুরু করেছিল জেএমবি। কিন্তু পরে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর আদর্শেও তারা অনুপ্রাণিত হল কেন, সেটা জানা জরুরি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন