সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে। ছবি: প্রদীপ আদক
আগেও বলেছেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ভর্তি-ব্যবস্থার কথা বারবার বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। কিন্তু ভর্তিতে ছাত্র সংসদের দাপট কমেনি। এবং কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ না-করলে দুর্নীতি-দাদাগিরির মোকাবিলা করা যে সম্ভব নয়, সেটা পরিষ্কার জানাচ্ছেন মন্ত্রীরই দফতরের একাংশ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সেই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্ত কিন্তু এখনও করা হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ভর্তিতে ফের অনলাইন ব্যবস্থার উপরেই জোর দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে শিক্ষাসচিব, যুগ্মসচিবদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকেও বসেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রী জানান, রাজ্য জুড়ে অনলাইন ব্যবস্থাতেই ভর্তি নিতে হবে পড়ুয়াদের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না-থাকায় দাদাগিরির ভূত নামবে কি না, দিনশেষে সেই সংশয় রয়েই গিয়েছে।
দাদাগিরি চলছে। এবং তা যে চলবেও, সেই আশঙ্কার মূলে আছে শিক্ষামন্ত্রীরই সংযোজিত মন্তব্য। তিনি জানান, অনলাইনে ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নবাগত ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতেই পারেন।
এতেই প্রমাদ গুনছেন ভুক্তভোগী এবং শিক্ষা শিবিরের একাংশ। তাঁদের আশঙ্কা, স্বয়ং মন্ত্রী এ ভাবে ছাত্র সংসদকে ‘সাহায্য’-এর যে-সুযোগ করে দিলেন, সেই ফাঁকেই দাপিয়ে বেড়াবে দাদাগিরির ভূত। নতুনতর আলখাল্লায় সেই ভূতের কেত্তন ভর্তির এই মরসুমে ফের শুরুও হয়ে গিয়েছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ভর্তি করিয়ে দেওয়ার নামে টাকা নেওয়ার অন্তত দু’টি অভিযোগে হস্তক্ষেপ করেছে শিক্ষা দফতর। ভর্তি হতে আসা ছাত্রছাত্রীদের ‘সাহায্য’ করার জন্য ছাত্র সংসদকে ছাড়পত্র দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই দাদাগিরির দাপট বাড়ানোর রাস্তা করে দিচ্ছেন বলে আশঙ্কা শিক্ষা শিবিরের।
গত পাঁচ বছরে ভর্তির প্রতিটি মরসুমেই নাস্তানাবুদ হওয়ার অভিজ্ঞতাই ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক এবং শিক্ষা মহলের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। রাজ্যের প্রায় সব কলেজেই এখন শাসক দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি-র সংসদ। ভর্তিতে ছাত্র সংসদের দাপাদাপি এবং অবৈধ ভাবে দেদার টাকা লেনদেনের মোকাবিলা করতেই চালু হয়েছে অনলাইন ব্যবস্থা। কিন্তু কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অভাবে দাদাদের দাপট চলছে। ‘হেল্প ডেস্ক’-এর নামে চূড়ান্ত দাদাগিরি চলছে বলে লাগাতার অভিযোগের মুখে কাগজে-কলমে সেই ডেস্ক-ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ও দুর্নীতিমুক্ত ভর্তি-প্রক্রিয়ার স্বার্থে হেল্প ডেস্ক প্রথার বিলোপ চাইছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-ও। মোড়ক বদলে নতুন পথে দাদাগিরি চালানোর ফিকির খুঁজে নিতে অবশ্য দেরি হয়নি দাদাদের। শিক্ষামন্ত্রী এখন যেটাকে ‘সাহায্য’ তকমা দিচ্ছেন, দাদারা সেটাকে তাঁদের সক্রিয়তায় জুড়ে নিয়ে আরও দাপাবেন বলেই ছাত্রছাত্রী এবং তাঁদের অভিভাবকদের আশঙ্কা।
অনলাইনে ভর্তির নির্দেশ নতুন নয়। কিন্তু বারেবারেই বেআইনি ভাবে টাকা নিয়ে ছাত্র ভর্তির অভিযোগ উঠেছে ছাত্র সংসদগুলির বিরুদ্ধে। পড়ুয়াদের সাহায্যের নামে বেশি টাকা নিয়ে ভর্তি করানোর ঘটনায় কাঠগড়ায় টিএমসিপি-ই। কিন্তু এত অভিযোগ সত্ত্বেও কলেজের গেটে ছাত্র সংসদের হেল্প ডেস্কের রমরমা কমেনি। শিক্ষামন্ত্রী এর আগে হেল্প ডেস্ক বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এ দিন আবার সাহায্যের কথা তুলে তিনি দাদাদের হেল্প-দাপটেই ইন্ধন জোগালেন বলে মনে করছে শিক্ষা শিবিরের একটি বড় অংশ।
ঠিক কী বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী?
‘‘অনলাইনের মাধ্যমেই পড়ুয়াদের ভর্তি নিতে হবে। তবে ছাত্র সংসদ তাদের সাহায্য করতেই পারে,’’ এ দিন নবান্নে বলেছেন পার্থবাবু।
ছাত্রছাত্রীদের কী ধরনের সাহায্যের কথা বলছেন শিক্ষামন্ত্রী?
পার্থবাবু বলেন, ‘‘ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা তো পড়ুয়াদের দ্বারাই নির্বাচিত। তাই কোনও পড়ুয়া বা অভিভাবক তাঁদের কাছে সাহায্য চাইতে যেতেই পারেন। ছাত্র সংসদ তাঁদের অনলাইনে ভর্তি হওয়ার নিয়মকানুন বুঝিয়ে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু অন্য কোনও ভাবে নয়।’’
বিকাশ ভবন সূত্রের খবর, রাজ্যের শিক্ষা দফতর একটি পোস্টার তৈরি করেছে। তার মাধ্যমে সচেতনতার প্রচার চলছে। পোস্টারে জানানো হয়েছে, কোনও ভাবেই কলেজে হেল্প ডেস্ক রাখা যাবে না। ভর্তি হতে আসা ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতে শিক্ষা দফতর একটি হেল্পলাইন চালু করেছে। কিন্তু তার পরেও ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা সাহায্য করবেন বলে মন্ত্রী নিজে জানানোয় দাদাগিরি আর দুর্নীতির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
অথচ ছাত্র সংসদের দাপট রুখতে মন্ত্রী আগেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজগুলিতে অনলাইন ব্যবস্থাও চালু করা যায়নি। শিক্ষা দফতরেরই একটি সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ভাবে অনলাইন ভর্তি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ না-করলে টাকার খেলা চলতেই থাকবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে কেন্দ্রীয় ভাবে এই পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ না-করলে সমস্যা মিটবে না। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলছেন, যে-ভাবেই হোক এ বার সর্বত্র অনলাইনেই ভর্তি হতে হবে পড়ুয়াদের। ইতিমধ্যেই টাকা নিয়ে ভর্তির খবর পেয়ে শিক্ষা দফতর দু’টি কলেজে ভর্তিতে হস্তক্ষেপ করেছে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
শিক্ষা দফতর কী কী পরিকল্পনা নিচ্ছে, তার ‘ভিশন ডকুমেন্ট’ তৈরির উপরে জোর দিচ্ছে সরকার। মন্ত্রী জানান, শিক্ষা দফতর আগামী পাঁচ বছরে কী কী পদক্ষেপ করতে চলেছে, সেই পরিকল্পনার নকশা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আগামী দশ বছরকে মাথায় রেখেও পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। আরও বেশি এডুকেশন হাব তৈরির পরিকল্পনাও আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের পদ্ধতিও শুরু হয়ে গিয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
এ-সব তো আগামীর পরিকল্পনা। ঘাড়ে এসে পড়া সমস্যা হচ্ছে ছাত্র-ভর্তি। অনলাইনে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এনে কেন সেই সমস্যার সুরাহা করা হচ্ছে না, তার জবাব মিলছে না।