পদ আছে কাজ নেই, ফাঁকাই পড়ে অফিস

সোমবার দুপুরে নব মহাকরণের পাঁচ তলায় ফিরোজা বিবির ঘর হাট করে খোলা। বাইরে বসে এক জন আর্দালি। ধোপদুরস্ত সাজানো-গোছানো ঘরে এসি চলছে। ঝাঁ-চকচকে টেবিলে ফাইলপত্র নেই বললেই চলে। এক কোণে পড়ে রয়েছে অল্প কিছু কাগজপত্র। দফতরের এক কর্মী বললেন, ‘‘ম্যাডাম খুব কমই আসেন।’’ যদিও সরকারি নিয়ম মেনে রোজ সকাল ১০টায় ঘরের দরজা খুলে বসে থাকেন তাঁরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০১৫ ০৩:০৯
Share:

ঝাঁ চকচকে, কিন্তু খাঁ খাঁ। নব মহাকরণে এক পরিষদীয় সচিবের ঘর। — নিজস্ব চিত্র।

সোমবার দুপুরে নব মহাকরণের পাঁচ তলায় ফিরোজা বিবির ঘর হাট করে খোলা। বাইরে বসে এক জন আর্দালি। ধোপদুরস্ত সাজানো-গোছানো ঘরে এসি চলছে। ঝাঁ-চকচকে টেবিলে ফাইলপত্র নেই বললেই চলে। এক কোণে পড়ে রয়েছে অল্প কিছু কাগজপত্র।

Advertisement

দফতরের এক কর্মী বললেন, ‘‘ম্যাডাম খুব কমই আসেন।’’ যদিও সরকারি নিয়ম মেনে রোজ সকাল ১০টায় ঘরের দরজা খুলে বসে থাকেন তাঁরা।

নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে সম্মান জানাতে ‘শহিদের মা’ ফিরোজা বিবিকে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের পরিষদীয় সচিব করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দফতরের কর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, সেই দায়িত্ব পাওয়ার পরে বেশ কিছু দিন টানা অফিস করেছিলেন ফিরোজা। নন্দীগ্রামের মানুষ দলে দলে আসতেন তাঁর কাছে। তার পর ধীরে ধীরে হাজিরায় টান পড়ে। দর্শনার্থীর সংখ্যাও কমে যায়।

Advertisement

অফিসে যে বড় একটা যাওয়া হয় না, সে কথা ঠারেঠোরে স্বীকার করে নিয়েছেন ফিরোজা নিজেও। কেন এই গরহাজিরা? ফিরোজার ব্যাখ্যা, ‘‘জেলায় আমাদের কত কাজ! কলকাতায় কি বসে থাকা চলে? ফাঁক পেলে মাঝেমধ্যে যাই।’’

প্রায় একই রকম যুক্তি দিলেন প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতরের পরিষদীয় সচিব চাঁদ মহম্মদ। বললেন, ‘‘নিজের বিধানসভা এলাকার কাজটাই বেশি করে দেখতে হয়। সে সব সেরে সময় পেলে অফিসে যাই।’’

অফিসে গিয়ে কী করেন? সেই জবাব অবশ্য মেলেনি এই দু’জনের কাছে। তবে আড়ালে একাধিক পরিষদীয় সচিবই কবুল করেছেন, ন’মাসে-ছ’মাসে অফিসে পা দিলেও তাঁদের প্রায় কোনও কাজই নেই। মন্ত্রীর ঘরেই বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। ২৩ জন পরিষদীয় সচিবের মধ্যে ১৪ জনই বসেন নব-মহাকরণে। তাঁদের এক জন এ দিন আরও বললেন, ‘‘কাঁহাতক একা বসে থাকা যায়! তাই দফতরে গেলে এলাকার কিছু নেতা-কর্মীকে ডেকে নিই। ওঁদের সঙ্গে় কিছুটা সময় কাটে।’’ তাঁর সতীর্থ অন্য এক পরিষদীয় সচিব নিজেকে তুলনা করলেন ‘কম্পালসারি ওয়েটিং’-এ থাকা আধিকারিকদের সঙ্গে। বললেন, ‘‘আমাদেরও ওই রকম অবস্থা। পদ আছে, কাজ নেই। কী করব অফিসে গিয়ে? কোনও ফাইলই আসে না।’’

আসার কথাও নয়। কারণ সরকারি দফতরে ফাইল ওঠানামার যে নিয়ম নির্দিষ্ট রয়েছে, তাতে পরিষদীয় সচিবের কোনও ভূমিকা নেই। গাদা গাদা বিধায়ককে ওই পদে বসালেও ফাইল চলাচলের নিয়মে কোনও বদল ঘটায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ফলে প্রশাসনের নিচুতলা থেকে উঁচুতলা, মায় মন্ত্রীরাও তাঁর দফতরের পরিষদীয় সচিবের কাছে ফাইল পাঠান না। অথচ ২০১২-এর শেষে বিধানসভায় পরিষদীয় সচিব নিয়োগ সংক্রান্ত বিল পেশ করে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজে বলেছিলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে যে উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে, তা এগিয়ে নিয়ে যেতেই এই নিয়োগ।’’ ব্যাখ্যা দেন, রাজ্যে আইএএস-আইপিএস এবং অন্যান্য আধিকারিকের সংখ্যা কম থাকায় পরিষদীয় সচিবের পদ গড়া হচ্ছে। বিলে পরিষদীয় সচিবের কাজের পরিধিও বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন পার্থবাবু।

কার্যক্ষেত্রে প্রশাসনের অধিকাংশ কর্তার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। নবান্নের এক যুগ্মসচিবের কথায়, ‘‘আমাদের মাথার উপরে সচিব আছেন, তার উপরে মন্ত্রী। উন্নয়নের কাজই হোক বা দফতরের কোনও সমস্যা, সমাধানের জন্য তাঁদের কাছেই আমাদের ফাইল পাঠাতে হয়। এই ফাইল চালাচালির মধ্যে পরিষদীয় সচিবের স্থান কোথায়, সেটাই বুঝতে পারলাম না।’’ তাই পরিষদীয় সচিবের কাছে ফাইল পাঠাননি— কবুল করছেন দফতরের নিচুতলার অফিসারদের বড় অংশই। একই সুরে পরিষদীয় সচিবদেরও অনেকে বলেছেন, ‘‘আমাদের দায়িত্ব কী, তা কেউ কোনও দিন ডেকে বলেননি। দু’বছর হয়ে গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত একটি প্রকল্পেও আমাদের কোনও ভূমিকা ছিল না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন