আঁধারে আলো শোভনাদেবী

অঙ্গদানের কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগ আটকে বৈঠকেই

অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে ঘিরে দেশ জুড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠা দালালচক্র বন্ধ করতে দু’বছর আগে দেশের বিভিন্ন অংশে পাঁচটি সমন্বয় কেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০০:১৫
Share:

শোভনা সরকার

অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে ঘিরে দেশ জুড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠা দালালচক্র বন্ধ করতে দু’বছর আগে দেশের বিভিন্ন অংশে পাঁচটি সমন্বয় কেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। পূর্বাঞ্চলে সেই নোডাল সেন্টার তৈরি হওয়ার কথা ছিল কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। কিন্তু বাস্তব ছবিটা বলছে, দু’বছরে হাতে গোনা কয়েকটি বৈঠক ছাড়া কার্যত আর কিছুই হয়নি।

Advertisement

এর মধ্যেই সোমবার রাতে এই শহরেই এক বৃদ্ধার মরণোত্তর অঙ্গদান খানিকটা আলো দেখিয়েছে। মিন্টো পার্কের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি শোভনা সরকার নামে ওই বৃদ্ধার মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়ার পরে তাঁর পরিবার অঙ্গদানে এগিয়ে আসায় বৃদ্ধার দু’টি কিডনি নতুন জীবন দিয়েছে রেনাল ফেলিওরের দুই রোগীকে। মঙ্গলবার দুপুরে শোভনাদেবীর দু’চোখের কর্নিয়া দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে আরও দু’জনকে। চিকিৎসক মহলের আশা, এর পরে বহু পরিবারই এই দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হবে। শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে যাঁদের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘোষণা করা হয়, তাঁদের অনেকের পরিবার এগিয়ে এলে এ শহরে অঙ্গ পাচার চক্রের রমরমা রুখে দেওয়া সম্ভব হবে বলেও তাঁরা আশাবাদী। কিন্তু সেই সঙ্গেই এই নজির ফের উস্কে দিয়েছে পুরনো প্রশ্ন— সাধারণ মানুষ যদি এগিয়েও আসেন, সরকার সেই অঙ্গ সংরক্ষণ ও যথাসময়ে তার ব্যবহারের ব্যাপারে কতটা প্রস্তুত? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে, কারণ সে জন্যই শোভনাদেবীর লিভারটি ব্যবহার করা যায়নি।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূলত মৃত মানুষের দেহ থেকেই অঙ্গ নিয়ে তা প্রতিস্থাপন হয়। কিন্তু এ দেশে তা অনেকটাই নির্ভর করে জীবিত দাতার উপরে। যদিও জীবিত মানুষের দেহ থেকে অঙ্গ নিয়ে অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন বন্ধ করে শুধুমাত্র মৃতদেহ থেকে অঙ্গ সংগ্রহ করে নজির গড়েছে তামিলনাড়ু। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এখনও সে পথে হাঁটতে পারেনি। কেন্দ্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতার পাশাপাশি সমন্বয় কেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা ছিল দিল্লি ও গুয়াহাটি-সহ আরও চারটি শহরে। এর মধ্যে দিল্লিতে ওই কেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। গুয়াহাটিতেও সেই কাজ শুরু হওয়ার পথে। কলকাতার কেন্দ্রটিতে অঙ্গ সংগ্রহের জন্য আলাদা অপারেশন থিয়েটার, বিশেষ প্রশিক্ষক দল ও অঙ্গ সংরক্ষণ ব্যাঙ্ক— সবই থাকার কথা। কিন্তু প্রক্রিয়া থমকে রয়েছে বৈঠকেই।

Advertisement

এসএসকেএমের ইউরো-নেফ্রো বিল্ডিংয়ে ওই পৃথক অপারেশন থিয়েটার তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, ওই কেন্দ্রে এক জন পূর্ণ সময়ের অধিকর্তা থাকবেন। তাঁর অধীনে কাজ করবেন দু’জন প্রতিস্থাপন কো-অর্ডিনেটর। সরকারি-বেসরকারি যে সব হাসপাতালে প্রতিস্থাপন হবে, তার সমস্ত তথ্য প্রত্যেকটি অস্ত্রোপচারের আগে সবিস্তারে জানাতে হবে ওই কেন্দ্রকে। স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি ছিল, এই প্রকল্প সফল হলে অঙ্গ পাচারের ঘটনা অনেকটাই বন্ধ করা সম্ভব হবে। কারণ জীবিত মানুষের দেহ থেকে অঙ্গ নেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সবটাই হবে মৃতদেহ থেকে।

কেন চালু করা গেল না ওই কেন্দ্র? প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্ব ছিল এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডের উপরে। এ দিন অবশ্য রাজেনবাবু বলেন, ‘‘আমি কিছু জানি না। এ ব্যাপারে আমার কিছু বলারও নেই।’’ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত মণ্ডলের অবশ্য দাবি, প্রকল্পে পিছিয়ে নেই তাঁরা। ভিতরে ভিতরে অনেকটাই কাজ এগিয়েছে। প্রস্তাবিত নোডাল সেন্টারটি শীঘ্রই চালু হবে। যদিও কাজ কী ভাবে এগোচ্ছে, তার সবিস্তার ব্যাখ্যা দিতে রাজি হননি সুশান্তবাবু।

রাজ্য স্তরে এমন উদ্যোগের মুখ থুবড়ে পড়া অবশ্য নতুন কিছু নয়। বছর দশেক আগে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সহায়তায় দু’টি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে যৌথ ভাবে একটি সমন্বয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। ‘ব্রেন ডেথ’ হয়ে যাওয়ার পরেও কৃত্রিম উপায়ে রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখা গেলে তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ— হৃদ্‌যন্ত্র, ফুসফুস, লিভার, কিডনি ইত্যাদি সচল থাকে। সেই অবস্থায় ওই ব্যক্তির দেহ থেকে প্রয়োজনীয় অঙ্গ তুলে অন্য কোনও রোগী, যাঁর সেই অঙ্গেরই প্রয়োজন, তাঁর দেহে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করার কথা ছিল ‘অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টার’ নামে ওই কমিটির। মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরেই যাতে রোগীর শরীর থেকে প্রয়োজনীয় অঙ্গ তুলে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে জনমত গঠন এবং পাশাপাশি তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল ওই কমিটির উপরে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ বিশেষ হয়নি।

কেন হয়নি? ওই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্ণধার ব্রজ রায় বলেন, “চোখ সংগ্রহের ব্যাপারে যেমন লাগাতার প্রচার চলে, অঙ্গ সংগ্রহ নিয়েও আমরা তেমনই কাজ করতে চাই। এ জন্য সরকারি তরফে আরও সাড়া প্রয়োজন।”

এ রাজ্যে ঘটা করে স্কিন ব্যাঙ্ক চালু করেও যথাযথ পরিকাঠামোর অভাবে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। চক্ষুদান নিয়ে আন্দোলন সফল হওয়া সত্ত্বেও চোখ সংরক্ষণের পরিকাঠামো এখনও নানা জায়গাতেই বেহাল। এই পরিস্থিতিতে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের এমন কেন্দ্র গড়ার কাজ কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকেরই। এমনকী এসএসকেএমের কেন্দ্রটি আদতে কী হতে চলেছে, সে সম্পর্কেও তাঁদের কিছু জানানো হয়নি বলে ব্রজবাবুর দাবি।

তবে এত সংশয়ের মধ্যেও কলকাতা এখন শোভনা সরকারের দৃষ্টান্তে উজ্জ্বল। গড়িয়ার বাসিন্দা ৩০ বছরের কেয়া রায় এবং কাশীপুরের বাসিন্দা শেখ ফিরোজের কিডনির সমস্যা ছিল বহু বছরের। নিয়মিত ডায়ালিসিস করাতে হত তাঁদের। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, দ্রুত প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করতে না পারলে বড়সড় বিপর্যয় ঘটে যাবে। কিন্তু কিছুতেই দাতার ব্যবস্থা হচ্ছিল না। শোভনাদেবীর কিডনি দান তাঁদের জীবনে আচমকাই যাবতীয় হতাশা কাটিয়ে দিতে পেরেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন