শিলিগুড়িতে চলছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। — নিজস্ব চিত্র
ঘটনা ১: প্রথমবার শাড়ি পরার অভিজ্ঞতার কথা গল্পের ছলেই প্রিয় বান্ধবীকে বলেছিল দশম শ্রেণির ছাত্রী সোমা (নাম পরিবর্তিত)। বলেছিল, বাড়িতে কয়েক জন অপরিচিত লোক এসেছিল, তাঁদের সামনে শাড়ি পরিয়ে হাজির করিয়েছিল বাড়ির লোকেরা। তাই আগের দিন স্কুলে আসা হয়নি।
গল্প শুনেই সোমার বান্ধবী মৌমিতার (নাম পরিবর্তিত) মনে হয়েছিল, ‘লক্ষণ ভাল নয়।’ ক’দিন আগেই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মশালা করেছে মৌমিতা। খবর পেয়েই শিলিগুড়ির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে সোমার বাড়িতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা গিয়ে জানতে পারে বিয়ের কথাবার্তা পাকা। স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে থানা সব পক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়। অনেক বোঝানোর পরে ছাত্রীর পরিবার আপাতত বিয়ে মুলতুবি রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
ঘটনা ২: এক শনিবার শিলিগুড়ির দেশবন্ধু বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষিকার ঘরে এসে ঢুকল একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্রী। প্রধান শিক্ষিকাকে তারা জানায় তাদের এক সহপাঠীর আগামী মাঘ মাসেই বিয়ে পাকা হয়ে গিয়েছে। সপ্তাহখানেক ধরে স্কুলেও আসছে না সে। আর স্থির থাকতে পারেননি প্রধান শিক্ষিকা সুদেষ্ণা মিত্র। তড়িঘড়ি ডেকে পাঠানো হয় ওই ছাত্রী ও তার পরিবারকে। খবর পেয়ে হাজির হন নাবালিকা বিবাহ রোধে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরাও। সুদেষ্ণা দেবী বলেন, ‘‘যে ভাবেই হোক বিয়েটা রুখতে হবে। ভাগিস্য ওর বন্ধুরা খবরটা দিয়েছিল।’’
এমনই বন্ধুত্বের হাত গত এক বছরে শিলিগুড়িতে রুখে দিয়েছে ১৫টি নাবালিকা বিবাহ। জলপাইগুড়ি জেলায় সেই সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ২২। এই ঘটনার পিছনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে দিল্লির এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
দিল্লির ওই সংগঠন দেশের কিছু বাছাই শহরে বাল্যবিবাহ ও শিশু নির্যাতন রোধে ‘চাইল্ড ফোর্স’ তৈরি করেছে। শিলিগুড়িতেও বেশ কিছু ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে সংগঠনটি। বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সাধারণত গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। ফলে কাছের বান্ধবীরাই সেই ঘটনার আঁচ পেতে পারে। এই কারণেই নজরদারির কাজে ছাত্রীদের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির কর্মকর্তা নন্দিতা প্রধান। তিনি বলেন, ‘‘প্রশিক্ষণে ছাত্রীদের বলা হচ্ছে কোনও সহপাঠী দু’এক দিন স্কুলে না এলেই খোঁজ নিতে।’’ বান্ধবীদের বাড়িতে হঠাৎ কোনও খাওয়ার আয়োজন হলে বা অপরিচিত লোকের যাতায়াত বাড়লেও তা নিয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে ছাত্রীদের। দ্রুত সংশ্লিষ্ট সংগঠনের কর্মী ও প্রধান শিক্ষিকাকে জানাতে বলা হয়েছে তাদের। শিলিগুড়িতে ৬টি স্কুলের ছাত্রীদের বেছে তৈরি হয়েছে বাহিনী। গোপন রাখা হয়েছে সেই বাহিনীর সদস্যদের নামও।
বান্ধবীদের হস্তক্ষেপ যে বেশি ফলপ্রসূ হয়, তা মানছেন শিলিগুড়ির পুলিশকর্তা ও সমাজ কল্যাণ আধিকারিকরাও। শিলিগুড়ির সিপি চেলিং সিমিক লেপচা বলেন, ‘‘স্কুলপড়ুয়াদের সচেতন করে সরাসরি কাজে লাগালে ভাল ফল মিলতে বাধ্য।’’ উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন দার্জিলিং জেলার সমাজ কল্যাণ আধিকারিক কমলেশ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘আমরা মূলত স্কুলে প্রচার চালাই। এই ধরনের উদ্যোগে আমাদেরও সাহায্য হবে।’’