স্টেশন সমরে নারী-পুরুষ

মার খেয়ে বেঁকে গেল চুড়ি, ছিটকে পড়ল দুল

১১ বছর ধরে অফিস টাইমে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করছি। এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যে হতে পারে, কখনও কল্পনাও করিনি। রাস্তাঘাটে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে এত কথা হয়! আজ সার কথাটা বুঝে গেলাম।

Advertisement

অদিতি রায় মল্লিক

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৩
Share:

বামনগাছি স্টেশনে অবরুদ্ধ মাতৃভূমি লোকাল। বুধবার সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

১১ বছর ধরে অফিস টাইমে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করছি। এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা যে হতে পারে, কখনও কল্পনাও করিনি। রাস্তাঘাটে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে এত কথা হয়! আজ সার কথাটা বুঝে গেলাম। যখন-তখন যেখানে সেখানে যা খুশি ঘটতে পারে। বিপদে পড়লে নিজেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে। পুলিশের সাহায্য পাওয়ার আশা করলে ভোগান্তি আরও বাড়বে।

Advertisement

সকাল ১০টা নাগাদ মধ্যমগ্রাম থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম। তখন জানতাম, ওটা বারাসত-শিয়ালদহ মাতৃভূমি লোকাল। পরে শুনলাম বারাসত নয়, ওটা বনগাঁ থেকে আসছে। স্টেশনে থিকথিক করছিল ভিড়। নারী-পুরুষ যেন দু’টো পৃথক দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সকলেই উত্তেজিত। এমনিতে প্রতিদিন যাঁদের মধ্যে হাসি বা কুশল বিনিময় হয়, এ দিন তাঁরাও পরস্পরকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন বিরক্তিতে, ঘৃণায়। প্রথমে কারণটা বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম মহিলা কামরা নিয়ে যে গোলমাল ক’দিন আগে শুরু হয়েছে, এটা তারই জের।

নয় বগির ট্রেন ‘মাতৃভূমি’। তার মধ্যে তিনটি কামরাকে ‘জেনারেল’ করে দেওয়া হয়েছে। একটি ভেন্ডরদের কামরা। বাকি কামরাগুলোতে মহিলারা যাতায়াত করেন। প্রতিদিন সেই কামরাগুলোতে কিছু পুরুষ যাত্রী উঠে আয়েস করে সিটের উপরে পা তুলে বসে আড্ডা মারেন। পুলিশ এলে লুকিয়ে পড়েন। পুলিশ চলে যেতেই ফের যে কে সেই। সাধারণ কামরা ফাঁকা থাকলেও সেখানে ওঠার কোনও উদ্যোগ থাকে না ওঁদের। সে নিয়ে মহিলারা প্রতিবাদ করতে গেলেই নানা বিদ্রূপ, কটূক্তি হজম করতে হয়।

Advertisement

এখন শুনছি, অনেকে বলছেন, মহিলা স্পেশ্যাল ট্রেনের ৭০ শতাংশই নাকি খালি থাকে। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। বারাসত থেকে ছাড়া ট্রেন মধ্যমগ্রামে পৌঁছলেই আর সিট পাওয়া যায় না। ট্রেনগুলো চালু হওয়ার পরে প্রথম দিকে হয়তো খালি থাকত, এখন বেশির ভাগ ট্রেনেই ভিড় থাকে। রেল কর্তৃপক্ষ মিথ্যা যুক্তি সাজিয়ে ট্রেনগুলো তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এ দিন যখন ট্রেন যখন এল, তখন দেখলাম সাধারণ কামরার পাশাপাশি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত কামরাতেও অবলীলায় পুরুষরা উঠছেন। ধাক্কাধাক্কি করছেন। আমাদের মধ্যে থেকে কয়েক জন বলল, ‘আপনারা এ খানে কেন? যেখানে আপনাদের ওঠার কথা সেখানে যান।’ কথা শেষ হতে না হতেই কয়েক জন পুরুষ যাত্রী সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘ওই কামরাগুলোতে খুব ভিড়। আমরা লেডিজ কামরাতেই উঠব। যা পারেন করে নিন।’ কথা কাটাকাটির মধ্যে ট্রেন ছাড়ল। ইতিমধ্যে ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে গোলমালের ব্যাপারটা ছড়িয়েছে। নানা স্টেশন থেকে অবরোধের খবর আসছে। সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে পুরুষ যাত্রীদের ভাবভঙ্গি।

খুব দ্রুত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছিলেন ওঁরা। ট্রেন বিরাটিতে থামতে না থামতেই কয়েক জন মহিলা যাত্রীকে হাত ধরে টানতে টানতে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিলেন। কারও ব্যাগ ধরে টানছিলেন। কারও শাড়ি, সালোয়ারের ওড়নায় টান দেওয়া হচ্ছিল। গোটা কামরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন এক দল পুরুষ। সকলেরই বয়স তিরিশের মধ্যে। এঁরা যে সকলেই যে প্রথম থেকে ওই কামরায় ছিলেন, তা-ও নয়। বিরাটি স্টেশন থেকেও উঠে পড়েছিলেন বেশ কয়েক জন। এরই মধ্যে রটে গিয়েছে, কোনও এক জন পুরুষ যাত্রীকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছেন মহিলারা। খবরটা ছড়াতেই তাণ্ডব আরও বেড়ে গেল। আমরা জানতে চাইলাম, ‘কাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে? আপনারা স্রেফ শোনা কথার ভিত্তিতে এ রকম করছেন কেন?’ এটা বলামাত্রই এক যুবক এগিয়ে এসে বললেন, ‘এই যে আমি! আমাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’ সেই কথা শুনে বাকিরা অশ্লীল ভাবে হাসতে শুরু করলেন।

এর মধ্যে আরও অনেক পুরুষই কামরায় ওঠার চেষ্টা করছিলেন। বুঝতে পারছিলাম, বিপদে পড়েছি। আতঙ্কের চোরাস্রোত ছড়িয়ে পড়ছিল সারা শরীরে। কারণ এ-ও বুঝতে পারছিলাম, বাঁচাতে আসবে না কেউ। নিজেদেরই কিছু করতে হবে। নতুন করে যাতে আর পুরুষরা উঠে আমাদের আক্রমণ করতে না পারেন, তাই আমরা অনেকেই গেটে হেলান দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। আমাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে কামরায় উঠে এলোপাথাড়ি কিল-চ়ড়-ঘুঁষি মারা শুরু হল। একটি মেয়ের নাকে নাকছাবি ছিল। তাকে এমন সপাটে চড় মারা হল যে তার নাক থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়তে শুরু করল। এক মহিলাকে মারতে মারতে আধমরা করে ফেলা হয়েছে। তিনি মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছিলেন। তত ক্ষণে আমিও বেশ কয়েকটা চড় খেয়েছি। হাতের ঘড়ি, কানের দুল কোথায় ছিটকে গিয়েছে কে জানে। পরে বাড়ি ফিরে দেখি, হাতের চুড়িগুলোও বেঁকে গিয়েছে।

অভিজ্ঞতার আরও বাকি ছিল। এর মধ্যে দেখলাম, ট্রেনের জানলা দিয়ে বাঁশের লাঠি, কঞ্চি দিয়ে খোঁচাচ্ছেন অনেকে। সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কাগজে পড়েছি, প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে ডাইনি সন্দেহে মহিলাদের পিটিয়ে মারা হয়। এক সময়ে অনেকটা সে রকম মনে হচ্ছিল। শ্লীলতাহানির কথা আর ওই সময়ে ভাবার মতো অবস্থায় ছিলাম না। ওই মুহূর্তে আমরা তখন তার চেয়েও অনেক বড় ভয় পাচ্ছিলাম— মৃত্যুভয়। ওখানে আমাদের সকলেরই তখন মনে হচ্ছিল, বেঁচে ফিরতে পারব না।

কান্নাকাটি, চিৎকার, দৌড়োদৌড়ির মধ্যেই আমরা যে যাকে পারছিলাম ফোন করে বলছিলাম, যে করে হোক আমাদের বাঁচানোর ব্যবস্থা করো। পুলিশ যে কত দূর নিষ্ক্রিয় হতে পারে উপলব্ধি করে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। ১০০ নম্বরে ডায়াল করেছি, যিনি ধরেছেন, তিনি সব কথা শুনে ফোন কেটে দিয়েছেন। জিআরপি-কে ফোন করেছি, স্থানীয় থানায় ফোন করেছি। নিমতা থানা থেকে ওখানে পৌঁছতে পাঁচ-সাত মিনিট সময় লাগে। অথচ পুলিশ এল এক ঘণ্টা পরে।

এ দিন হয়তো কোনও ক্রমে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু এর পর? এর পর কি আর আগের মতো নিশ্চিন্তে ট্রেনে উঠতে পারব! এই ঘটনা যে আজকেই শেষ হয়ে যাবে, তা ভাবা ভুল। দু’পক্ষের ভিতরেই তো ক্ষোভের আগুন ধিকধিক করে জ্বলছে। যে কোনও দিন আবার আগুন জ্বলবে। আর নিরাপত্তার যা বহর দেখলাম, তাতে তো প্রতিদিন এই উদ্বেগ নিয়েই আমাদের যাতায়াত করতে হবে। রেল যে নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থা করতে পারবে না তার প্রমাণ তো পেয়েই গেলাম। আর পুলিশ? তাদের কাছে নিরাপত্তা আশা করার ভুল আর করব না। এখন থেকে সবটাই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলতে হবে।

লেখক আয়কর দফতরের আধিকারিক।

(নিরাপত্তার কারণে ছবি দেওয়া হল না)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন