নিজের তহবিলে ৫১ লক্ষ, গোটা রাজ্যে নজির গড়েছে কান্দুয়া

হাতে নিজস্ব তহবিল থাকলে কি না করতে পারে পঞ্চয়েত! এলাকায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকেন্দ্র খোলাই হোক, বা কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া সাঁকো পুরোপুরি গড়ে ফেলা। হাওড়ার সাঁকরাইলের কান্দুয়া গ্রাম পঞ্চায়েত—এমন অনেক কিছুই করে দেখিয়েছে।

Advertisement

নুরুল আবসার

সাঁকরাইল শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০২:০০
Share:

পঞ্চায়েতের তহবিলে গড়ে ওঠা কংক্রিটের সেতু। ছবি: সুব্রত জানা।

হাতে নিজস্ব তহবিল থাকলে কি না করতে পারে পঞ্চয়েত! এলাকায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকেন্দ্র খোলাই হোক, বা কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া সাঁকো পুরোপুরি গড়ে ফেলা। হাওড়ার সাঁকরাইলের কান্দুয়া গ্রাম পঞ্চায়েত—এমন অনেক কিছুই করে দেখিয়েছে। তৃণমূল পরিচালনাধীন এই পঞ্চায়েতের কাজকর্ম নজর কেড়েছে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের কর্তাদের। তাঁদের সুপারিশে কোন উপায়ে তহবিল গড়েছেন, সে ব্যাপারে জাতীয় স্তরের আলোচনাসভায় বক্তব্য জানিয়ে এসেছেন কান্দুয়া পঞ্চায়েতের কর্তারা।

Advertisement

এলাকায় বাস করে ৫,২৮০টি পরিবার। রয়েছে বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর পাঁচটা পঞ্চায়েতের সঙ্গে কান্দুয়ার ফারাক কোথায়? পঞ্চায়েত কর্তারা জানাচ্ছেন, নিয়মিত এলাকাবাসীর সম্পত্তির মূল্যায়ন এবং তার ভিত্তিতে কর আদায় করেই নিজস্ব তহবিল গড়ে তুলতে পেরেছে কান্দুয়া। প্রতি বছরের গোড়ায় প্রতিটি পরিবারকে ছাপানো ফর্ম (৫-এ) দিয়ে দেওয়া হয়। তাতে পরিবারগুলি নিজস্ব জমি এবং বাড়ির তথ্য লিখে জমা দেন। ফর্ম পেলে পঞ্চায়েত বাজারদর অনুযায়ী সম্পত্তির মূল্যায়ন করে। সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতে কার কত কর তার তালিকা তৈরি করে পঞ্চায়েত অফিসে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। গ্রাম সংসদে বৈঠক করে, মাইকের মাধ্যমে প্রচার করে, প্রয়োজনে শিবির খুলে সেই টাকা এলাকাবাসীর কাছ থেকে আদায় করা হয়। একই ভাবে কর আদায় করা হয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির কাছ থেকে। এ ছাড়া, ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে এবং টোল আদায় করে কর-বহির্ভূত খাতে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।

২০০৫-০৬ সাল থেকেই নিজস্ব তহবিল বাড়ানোর উপরে জোর দিয়েছে কান্দুয়া। পঞ্চায়েত সূত্রের খবর, ২০০৫-০৬ সালে যেখানে নিজস্ব তহবিল সংগ্রহ হয়েছিল সাত লক্ষ টাকা, ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে তা বেড়ে হয়েছে ৫১ লক্ষ টাকা। ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৬০ লক্ষ টাকার।

Advertisement

নিজস্ব এই তহবিল কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করেছে কান্দুয়া। যেমন—আবাদা ফিডার রোডের ধারে শাসমলপাড়ায় সাঁকো গড়া। বর্ষায় প্রায় তিন মাস জলে ডুবে থাকে চারিদিকের এলাকা। ফলে, বিপাকে পড়েন শাসমলপাড়ার গোটা কুড়ি পরিবার। বাসিন্দাদের দাবি ছিল, ফিডার রোড থেকে বসতি পর্যন্ত জলাজমির উপর দিয়ে একটি কংক্রিটের সাঁকো তৈরি করে দেওয়ার। বিশ্ব ব্যাঙ্কের টাকায় কেন্দ্রের আইএসজিপি প্রকল্পে সাঁকোর কাজ শুরু হয়। কিন্তু টাকার অভাবে আংশিক কাজের পরে প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। পঞ্চায়েত নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ লক্ষ টাকা খরচ করে বাকি কাজ শেষ করেছে। মুখে হাসি ফুটেছে শাসমলপাড়ার বাসিন্দাদের।

এমনিতে কাছেপিঠে হাসপাতাল থাকলে কোনও গ্রাম পঞ্চায়েতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকেন্দ্র খোলা যায় না। মেলে না সে বাবদ সরকারি সহায়তাও। এই নিয়মের গেরোয় পড়েও দমে যাননি পঞ্চায়েতের কর্তারা। পঞ্চায়েতের নিজস্ব তহবিলের টাকাতেই খোলা হয়েছে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকেন্দ্র। চিকিৎসকের ভাতা এবং ওষুধের দাম মেটানো হচ্ছে পঞ্চায়েতের তহবিল থেকে। অসংখ্য গরিব মানুষ কার্যত বিনা পয়সায় চিকিৎসা পাচ্ছেন।

তহবিল বাড়ানোর ক্ষেত্রে মূল উদ্যোক্তা তৃণমূলের প্রধান অলোক দেটি। তিনি বলেন, ‘‘২০০৩ সালে এখানে সাধারণ সদস্য ছিলাম। তখন থেকেই আমার মনে হয়েছিল, গ্রামবাসীদের উপযুক্ত পরিষেবা দিতে হলে শুধুমাত্র কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের টাকার ভরসায় থাকলে হবে না। ২০০৮ সালে উপপ্রধান থাকাকালীন তহবিল বাড়ানোর নির্দিষ্ট পদ্ধতি চালু করি। প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পরেও তা চালু রেখেছি। তহবিলের টাকায় প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ করেছে পঞ্চায়েত।’’ অন্যদিকে নাবঘরা মধ্যপাড়ার বাসিন্দা পেশায় চাষি বিশ্বনাথ দাস বলেন, ‘‘প্রতি বছর নিজে আমি আমার সম্পত্তির বিবরণ দিই। তার ভিত্তিতে পঞ্চায়েত যে কর ধার্য করে তা মিটিয়ে দিই।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘নলকূপ মেরামতির মতো ছোটখাটো কাজ পঞ্চায়েত তাড়াতাড়ি করে দেয়। আমরা কর না দিলে পঞ্চায়েত এটা করতে পারবে কেন?’’ সুলাটি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক সমতুল চন্দ্র বলেন, ‘‘৫এ ফরম পূরণ করে আমি সম্পত্তির বিবরণ দিই। তার ভিত্তিতে যে মূল্যায়ন হয়, সেই অনুপাতে প্রতি বছর করও দিই। বিনিময়ে পঞ্চায়েতের কাছে আমরা বাড়তি পরিষেবা দাবি করতে পারি।’’

পঞ্চায়েতগুলির নিজস্ব তহবিল বাড়ানোর জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার জোর দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের প্রকল্পের টাকা খরচ করতে হয় নিয়ম মেনে। কিন্তু নিজস্ব তহবিল বাড়ানো হলে তা দিয়ে পঞ্চায়েতগুলি গ্রামবাসীদের ছোটখাটো চাহিদা মেটাতে পারে। ফলে, গতি আসে উন্নয়নে।

আইএসজিপি (গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির প্রাতিষ্ঠানিক সশক্তিকরণ) প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাঙ্ক গত পাঁচ বছর ধরে যে এক হাজার পঞ্চায়েতের উন্নয়নে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে, সেই প্রকল্পেও পঞ্চায়েতগুলিকে নিজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের বিশেষ সচিব দিলীপ পাল বলেন, ‘‘প্রশিক্ষণ পেলেও, সবাই যে তা ব্যবহার করে নিজস্ব তহবিল বাড়াতে পারে এমনটা নয়। ৫এ ফর্ম বিলি করে গ্রামবাসীদের নিজেদের ঘোষণা করা সম্পত্তির মূল্যায়নের ভিত্তিতে কর আদায় করে কান্দুয়া পঞ্চায়েতের তহবিল বাড়ানোর এই পদ্ধতির নজির মেলা দুষ্কর।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন