নিখিল বঙ্গ সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির অনুষ্ঠানে পার্থ। —নিজস্ব চিত্র
বিভিন্ন মহলে আপত্তি ওঠার পরে ‘বায়োমেট্রিক’ শব্দটির উল্লেখ না-করেই সংশোধিত শিক্ষা বিল সদ্য পাশ হয়েছে বিধানসভায়। কিন্তু ওই আধুনিক প্রযুক্তিতে হাজিরা নয়ই বা কেন, রবিবার ফের সেই প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এবং সেই প্রশ্নেই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাজিরায় নজরদারি চালানো হবে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির মাধ্যমে।
বিল থেকে বায়োমেট্রিক শব্দটির বিসর্জনের পরে প্রশ্ন উঠেছেল, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ির রাস্তা থেকে কি সরকার সরে এল? এসে থাকলে কেন এল? সরে আসার প্রশ্ন নেই বলে জানিয়ে মন্ত্রীর জবাব ছিল, তাঁরা শিক্ষকদের বিবেকের উপরে বিষয়টি ছেড়ে দিচ্ছেন। এ দিন সল্টলেকের বিদ্যুৎ ভবনে নিখিল বঙ্গ সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির ৩৩তম বার্ষিক সম্মেলনে শিক্ষকদের হাজিরা প্রসঙ্গে বিবেককে ফের টেনে এনেছেন পার্থবাবু।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যদি বিধানসভায় সই করে কাজ করতে পারেন, শিক্ষকেরা হাজিরার খতিয়ান দিয়ে মাইনে নিতে পারবেন না কেন, প্রশ্ন তোলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যের ৪০টি কলেজ এবং বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই শিক্ষকদের উপস্থিতির হার দেখা হচ্ছে। বাকি কলেজগুলোতেও কাজ চলছে।’’ এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষকদের উদ্দেশে তাঁর প্রশ্ন, টেলিফোন থেকে স্মার্ট ফোনে উত্তরণ ঘটেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে প্রতিদিনই। তা হলে সময়ানুবর্তিতায় নজরদারির ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে না কেন? ‘‘শিক্ষকেরা সমাজ গড়ার কারিগর। তাঁদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখছি, হাজিরার কড়াকড়িতে প্রযুক্তির ব্যবহার হবে না কেন? শিক্ষা তো সেবা। সেখানে সময়ে হাজিরা নিয়ে এত ‘গেল গেল’ রব তোলার কী আছে! তা ছাড়া সরকার টাকা দেবে অথচ নজরদারি রাখবে না, এটাই বা কেমন কথা,’’ ফের সেই ‘টাকা দিই, হস্তক্ষেপ করব না কেন’র সুরে ফিরে যান শিক্ষামন্ত্রী।
সরকার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ উঠছে বারে বারেই। পার্থবাবুর বরাবরের বক্তব্য, সরকার টাকা দেয় বলেই শিক্ষায় হস্তক্ষেপ করতে পারে। তাঁর সেই উক্তি নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা বিল পেশ করতে গিয়েও তিনি জানিয়েছিলেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চলে মানুষের টাকায়। সেখানে ঠিকঠাক কাজ না-হলে সরকার হস্তক্ষেপ করবেই। কারণ, সরকার জনগণের প্রতিনিধি। সেই সঙ্গেই বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অনিয়মের খতিয়ান তুলে ধরেন তিনি। হাজিরা ও হস্তক্ষেপ দু’টি বিষয়কে মিলিয়ে দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী এ দিন শিক্ষায় সরকারের ভূমিকাটিকে আরও এক বার প্রাঞ্জল করে দিলেন বলেই মনে করছে শিক্ষা শিবির।
তৃণমূলের জমানায় শিক্ষকদের প্রাপ্তিযোগের উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী জানান, এ রাজ্যে কোনও মুখ্যমন্ত্রী এই প্রথম শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করলেন। শিক্ষকদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগও করে দিচ্ছেন তিনি। এবং শিক্ষকেরা এ-সব পাচ্ছেন কোনও রকম আন্দোলন না-করেই। ‘‘শিক্ষকেরা সবই পেয়েছেন। কিছুই বাদ নেই। শিক্ষকেরা কোনও না-পাওয়ার তালিকা বানাতে পারবেন না। যদি পারেন, আমাকে দিন। আমি জানতে চাই, এমন কিছু আছে কি, যা আপনারা পাননি,’’ প্রশ্ন পার্থবাবুর।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ৬৫-তে শিক্ষকদের অবসরের ব্যবস্থা করতে বললেও এ রাজ্যে পার্থবাবুরা সেটা পুরোপুরি মানেননি। শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬২ করা হয়েছে। অপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে এটা এবং পুনর্নিয়োগ স্থগিত রাখার কথা বলে থাকেন শিক্ষকেরা। পার্থবাবু জানিয়ে দেন, তরুণ-তরুণীদের সুযোগ দেওয়ার জন্যই ৬২ বছরের পরে শিক্ষকদের আর নিজ নিজ পদে বহাল থাকা উচিত নয় বলে মনে করেন তাঁরা। পুনর্নিয়োগ বন্ধ যে কতটা জরুরি, ফের সেটা মনে করিয়ে দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘আমরা নতুনদের সুযোগ দিতে চাই। আর জগদীশচন্দ্র বসু, অমর্ত্য সেনের মতো ব্যক্তিত্ব ছাড়া আর কারও পুনর্নিয়োগ উচিত নয় বলেই মনে করি আমরা।’’
পার্থবাবু জানিয়ে দেন, তাঁদের শাসনে শিক্ষায় নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি দেখা হবে না। ‘‘বাম জমানায় রাজ্যের ৮০ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হতো। কিন্তু এই সরকার সেটা করছে না। শিক্ষা ক্ষেত্রে একমাত্র মাপকাঠি উৎকর্ষ,’’ বলেন শিক্ষামন্ত্রী।
খেটে খাওয়ার মানসিকতা ফিরে এসেছে বলে এ দিনের অনুষ্ঠানে দাবি করেন শাসক দল সমর্থিত শিক্ষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এ বারের শিক্ষা বিল পথ-নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করছে।’’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ ঘোষ, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোপাল মিশ্র, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাসব চৌধুরীও।