সচেতন করতে লিফলেট বিলি নানা স্টেশনে। নিজস্ব চিত্র।
স্টেশনে মাইকে প্রচার থেকে প্ল্যাটফর্মে নাটক— টানা সচেতনতামূলক প্রচারের ফলে দৌরাত্ম্যে খানিকটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু ট্রেনে মাদক মেশানো খাবার খাইয়ে যাত্রীদের জিনিস লুঠপাট ফের শুরু হয়েছে। যা আবার কপালে ভাঁজ ফেলেছে রেলের কর্তাদের। রেলরক্ষী বাহিনী (আরপিএফ) জানায়, ধারাবাহিক নজরদারি চালানো হচ্ছে। অস্বাভাবিক কিছু নজরে এলে ১৮২ নম্বরে ফোন করে খবর দেওয়ার আর্জি জানানো হচ্ছে যাত্রীদের।
পূর্ব রেলের বর্ধমান থেকে দুর্গাপুর, আসানসোল হয়ে ঝাড়খণ্ডে চলে যাওয়া লাইন এবং অন্ডাল-সাঁইথিয়া লাইনের বিভিন্ন ট্রেনে মাদক খাইয়ে লুঠের রীতি অনেক দিনের। তাতে শুধু সর্বস্ব খোয়ানো নয়, অনেক সময়ে যাত্রীর মৃত্যুও হয়েছে। এমন ঘটনা বাড়তে থাকায় এক সময়ে ধারাবাহিক অভিযানে নামেন রেল কর্তৃপক্ষ। অপরিচিত সহযাত্রীর কাছ থেকে কিছু না খাওয়া, হকারদের কাছে কোনও খাবার কেনার সময়ে সতর্ক থাকার আবেদন করা হয় যাত্রীদের। সচেতন করতে নেওয়া হয় নানা কর্মসূচি। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে ধরপাকড়ের পরে এই দুষ্কর্ম খানিকটা বন্ধ হয়েছিল।
কিন্তু সেই চক্র যে আবার সক্রিয় হয়েছে তা সম্প্রতি এক ঘটনায় সামনে এসেছে। দিন দশেক আগে আসানসোল ডিভিশনের অন্ডাল-সাঁইথিয়া লাইনের উখড়া স্টেশনে এক লোকাল ট্রেন থেকে অচেতন অবস্থায় এক যুবককে উদ্ধার করে আরপিএফ। স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করানোর পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ওই যুবকের কাছে কোনও জিনিসপত্র পাওয়া যায়নি। এখনও তাঁর নাম-পরিচয় জানা যায়নি। রেল সূত্রের খবর, তদন্ত করে জানা গিয়েছে, ওই যুবককে মাদক মেশানো খাবার খাইয়ে সব কিছু লুঠ করা হয়েছে। মাদকের পরিমাণ বেশি থাকায় ও চিকিৎসা পেতে দেরি হওয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে রেলকর্তা ও চিকিৎসকদের অনুমান।
এর পরেই মাদক মেশানো খাবার খাইয়ে লুঠের ঘটনা ঠেকাতে ধারাবাহিক যাত্রী সচেতনতা অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানায় রেল। আসানসোল ডিভিশনের সব স্টেশনে পোস্টার-ব্যানার সাঁটিয়ে, যাত্রীদের মধ্যে লিফলেট বিলি করে, মাইকে বক্তব্য রেখে সচেতন করা হচ্ছে। কোনও অপরিচিতের কাছে খাবার বা পানীয় না নেওয়ার আবেদন জানানো হচ্ছে যাত্রীদের। অস্বাভাবিক কিছু নজরে এলে ১৮২ নম্বরে ফোন করে খবর দিতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
আরপিএফের আসানসোল ডিভিশনের ইনস্পেক্টর দীপঙ্কর দে দীর্ঘদিন এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি জানান, এই দুষ্কর্মে জড়িতরা সাধারণত যাত্রী সেজে কামরায় ওঠে। টিকিট কাউন্টার বা স্টেশন থেকে তারা শিকার ঠিক করে নেয়। কামরায় চেপে সেই যাত্রীর সঙ্গে ভাব জমায়। তার পরে এক সময়ে কাজ হাসিল করে সরে পড়ে। দীপঙ্করবাবু বলেন, ‘‘অপরাধীরা নির্দিষ্ট কোনও কৌশল নেয় না। সুযোগ অনুযায়ী যে কোনও উপায়ে পানীয় বা খাবারে মাদক মিশিয়ে দেয়। তা এতটাই কড়া হয় যে সামান্য পরিমাণ মেশালেই যাত্রী অচেতন হয়ে যায়।’’
এর হাত থেকে বাঁচতে সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি দাবি করেন দীপঙ্করবাবু। তিনি আরও জানান, এই রাজ্য ও ঝাড়খণ্ড সীমানার কয়েকটি গ্রামের কিছু বাসিন্দা এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। স্থানীয় থানার পুলিশের সাহায্যে ওই সব গ্রামে কয়েক বার অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে আরপিএফ। ধারাবাহিক অভিযানে মাঝে এই অপরাধ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দীপঙ্করবাবু বলেন, ‘‘ছোট-ছোট দল করে অভিযান চালানো হচ্ছে।’’ আসানসোল ডিভিশনের জনসংযোগ আধিকারিক বিশ্বনাথ মুর্মু বলেন, ‘‘রেলের তরফে বিভিন্ন স্টেশনে ৩০ জুন পর্যন্ত সচেতনতা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’
উখড়া স্টেশন থেকে উদ্ধার করা অচেতন ওই যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল খান্দরা ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিরুদ্ধে। ওই যুবককে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে রেফার করা হলেও তাঁকে নিয়ে য়াওয়ার জন্য কোনও গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেন গাড়ির বন্দোবস্ত করলেন না, সে নিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয় মহকুমা প্রশাসন। দুর্গাপুরের মহকুমাশাসক শঙ্খ সাঁতরা বলেন, ‘‘আমরা বিএমওএইচ-এর উত্তরে সন্তুষ্ট হইনি। তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।’’ মৃত যুবকের পরিচয় জানতে আশপাশের সব জেলা ও পাশ্ববর্তী রাজ্যের নানা থানায় ছবি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।