প্যাথ-ল্যাব বিতর্ক

এক পরীক্ষায় ভিন্ন খরচ কেন, নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন

ব্যারাকপুরের বলরাম সাধুখাঁ রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় এক প্যাথলজি ল্যাবরেটরিতে গিয়েছিলেন। ওই পরীক্ষার জন্য দিতে হয় ৮০০ টাকা। কিন্তু রিপোর্ট দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি চিকিৎসক।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৮
Share:

ব্যারাকপুরের বলরাম সাধুখাঁ রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় এক প্যাথলজি ল্যাবরেটরিতে গিয়েছিলেন। ওই পরীক্ষার জন্য দিতে হয় ৮০০ টাকা। কিন্তু রিপোর্ট দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি চিকিৎসক। অন্য কোনও সংস্থা থেকে আরও এক বার ওই দু’টি পরীক্ষা ফের করানোর পরামর্শ দেন তিনি।

Advertisement

বলরামবাবু অন্য একটি সংস্থায় পরীক্ষা করান। সেখানে একই পরীক্ষার জন্য ৩৫০ টাকা দিতে হয়। একই পরীক্ষা, অথচ দু’টি জায়গায় খরচের এতটা ফারাক কেন? প্রথম ল্যাবটিতে গিয়ে বলরামবাবু এই প্রশ্ন তুলতেই, কথা না বাড়িয়ে তারা কিছু টাকা ফিরিয়ে দেয় বলরামবাবুকে।

নৈহাটির চম্পা চৌধুরীর কিডনির অসুখের জন্য রক্ত পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন পড়ে। তিনিও নৈহাটি ও ব্যারাকপুরের দু’টি ল্যাবে দু’রকম চার্জ দেখে প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি, কোথায় পরীক্ষা করাবেন। অনেক ভেবে যেখানে খরচ কম, সেখানেই নমুনা পরীক্ষা করান। এন্ডোস্কোপি করতে গিয়ে একই অবস্থা হয় খড়দহের রীতা মোহান্তেরও।

Advertisement

গোটা রাজ্যে প্যাথলজি ল্যাবরেটরিগুলি যেমন খুশি টাকা নিচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য। এই ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি বেঁধে দেওয়ার জন্য কোনও আইন নেই। রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বেসরকারি এই সংস্থাগুলি (প্যাথ ল্যাব) পরীক্ষার জন্য কী খরচ নেবে, সেটা তাদের ব্যাপার। এ ব্যাপারে রাজ্যের কিছুই করার নেই,
এক্তিয়ারও নেই।’’

স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, আগে যখন সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজি ল্যাবে পরীক্ষা করানোর জন্য রোগীদের টাকা দিতে হত, সেই সময় বেসরকারি প্যাথ ল্যাবগুলিও সতর্ক থাকত। সরকারি দরের চেয়ে কম টাকাতেই তারা বিভিন্ন পরীক্ষা করত। কিন্তু এখন সরকারি হাসপাতালে সব কিছুই বিনামূল্যে করা হয়। তাই সরকারি দর বলে কিছু নেই। ফলে বেসরকারি ল্যাবগুলির পোয়াবারো। তবে নমুনা পরীক্ষা সঠিক না হলে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মন্তব্য করেন ওই কর্তা। তবে তার জন্য রোগীকে সংশ্লিষ্ট জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে।

সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় গোটা রাজ্যেই রাতারাতি ছাতার মতো এখন গজিয়ে উঠেছে প্যাথ-ল্যাব। রোগীদের অভিযোগ, বেশি টাকা তো বটেই, ওই সব ল্যাবের রিপোর্টেরও মাথামুন্ডু নেই। যেমনটা হয়েছে, বলরামবাবুর ক্ষেত্রেও। প্রথম সংস্থার রিপোর্ট এমন হয়েছিল যে চিকিৎসক বলরামবাবুকে ফের অন্য প্যাথ-ল্যাবে পাঠান।

সংস্থাগুলির অবশ্য দাবি, নমুনা পরীক্ষার খরচ বেড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন কিটের দাম বেড়েছে। বেড়েছে আনুষঙ্গিক খরচও। ফলে এখন অল্প টাকায় পরীক্ষার মান ভাল করা সম্ভব হয় না। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অনেকেরই পাল্টা অভিযোগ, টাকা দিয়েও আশানুরূপ মান পাওয়া যাচ্ছে না। একই পরীক্ষার জন্য ফের অন্য সংস্থায় দৌড়তে হচ্ছে!

কিন্তু সত্যিই কতটা খরচ হয় নমুনা পরীক্ষার জন্য? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, কিডনির ক্রিয়েটিনিন ইউরিয়া পরীক্ষার জন্য খরচ ১৫ টাকা। তার সঙ্গে যুক্ত হবে প্যাথ ল্যাব চালানোর খরচ। তাই মোটামুটি ১০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া যেতে পারে। অথচ এই পরীক্ষার জন্য ব্যারাকপুরের বলরামবাবুকে একটি ল্যাবরেটরিতে দিতে হয়েছে ৩৫০ টাকা, আর এক জায়গায় ৮০০ টাকা। একই ভাবে লিভার ফাংশন টেস্টের জন্য খরচ পড়ে ৩৫ টাকার মতো। ল্যাবগুলি দিব্যি ৪০০ থেকে
৬০০ টাকা করে নিচ্ছে।

কলকাতার একটি প্যাথ-ল্যাবের প্রবীণ চিকিৎসক সুবীর দত্ত বলেন, ‘‘এই ল্যাবগুলিকে লাইসেন্স দেয় স্বাস্থ্য দফতর। তারা রোগীদের থেকে কী টাকা নেবে, সে ব্যাপারে নীতি ঠিক করা তো দূর, তারা ঠিক রিপোর্ট দিচ্ছে কি না, সেটা দেখারও লোক নেই স্বাস্থ্য দফতরে।’’ জেলাগুলির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা অবশ্য সুবীরবাবুর অভিযোগ মানতে নারাজ। উত্তর ২৪ পরগনার জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয় আচার্য বলেন, ‘‘অভিযোগ পেলেই স্লাইড এনে সরকারি ভাবে ফের পরীক্ষা করে দেখা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তিও দেওয়া হয়।’’ প্রলয়বাবু জানান, গত ছ’মাসে আটটি ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা অনিরুদ্ধ করের মতে, অনেক সময় চিকিৎসকেরা বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য রোগীদের নির্দিষ্ট ল্যাবরেটরিতে যেতে বলেন। এর জন্য তাঁরা সংশ্লিষ্ট ল্যাব থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পান। আর তার জেরে অনেকটা বেড়ে যায় পরীক্ষার খরচ। চিকিৎসকদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন, ‘‘প্রয়োজনে সরকার তো বাজারে আলু-পটলের দামও বেঁধে দেয়। তা হলে ল্যাবরেটরিগুলিকে লাগামছাড়া দাম নিতে দেওয়া হচ্ছে কেন?’’ তাঁরা চান, সরকার সব দিক বিবেচনা করে এই ব্যাপারে নিয়ম-নীতি তৈরি করুক। তা না হলে রোগীদের হেনস্থা কমবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন