খালের জলেই ‘সাফ’ রোগীর চাদর

খালপাড়ে খোলা মাঠে বিছানো সার সার সাদা চাদর। যেন সবুজ ঘাসে সাদা কার্পেট পাতা। নরম চাদরের উপরে দিবানিদ্রায় মগ্ন বিড়াল-কুকুরেরা। চাদরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কখনও শুয়োর, কখনও বা গরু। খালপাড়ের এই মাঠে জোঁকের উপদ্রবও আছে।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৪৬
Share:

মাঠে শুকোচ্ছে হাসপাতালের কাপড়। বুধবার, ইছাপুরে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

খালপাড়ে খোলা মাঠে বিছানো সার সার সাদা চাদর। যেন সবুজ ঘাসে সাদা কার্পেট পাতা। নরম চাদরের উপরে দিবানিদ্রায় মগ্ন বিড়াল-কুকুরেরা। চাদরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কখনও শুয়োর, কখনও বা গরু। খালপাড়ের এই মাঠে জোঁকের উপদ্রবও আছে। পাশেই পাটখেত। বর্ষায় সেই পাট ভেজানো হয় খালের জলে। এক দিকে বড় ড্রামে জীবাণুনাশক দিয়ে ভেজানো কাপড় তুলে মেলে দেন জনা দশেক লোক। শুকিয়ে গেলে সেই কাপড়ই ভাঁজ হয়ে ট্রাকে করে পৌঁছে যায় সরকারি হাসপাতালে। আপাতত রেলের বি আর সিংহ হাসপাতালের কাপড় শুকোচ্ছে ব্যারাকপুর-কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ইছাপুর খালপাড়ের ওই মাঠে। যা শুনে চোখ কপালে উঠেছে বহু চিকিৎসকের।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন বা ‘হু’)-র নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতিটি সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে সিএসডি (সেন্ট্রাল স্টেরিলাইজেশন ডিপার্টমেন্ট) থাকা বাধ্যতামূলক। ওই দফতর রোগীদের বিছানার চাদর থেকে শুরু করে অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকদের ব্যবহৃত অ্যাপ্রন পরিষ্কার করার বিষয়টি নজরে রাখে। নিয়ম বলছে, ওই সব জিনিস পরিষ্কারের ক্ষেত্রে হাসপাতালের নিজস্ব পরিকাঠামো না থাকলে বাইরে থেকে করাতে হবে। কিন্তু সেটাও করকে হবে পরিচ্ছন্নতার যাবতীয় নিয়ম মেনেই।

সমস্ত নিয়মই থোড়াই কেয়ার। খালের জলেই ধোয়া-কাচা হচ্ছে রোগীদের পোশাক থেকে বালিশের ঢাকা। নিয়মরক্ষার্থে একটি ওয়াশিং মেশিন আছে অবশ্য। কিন্তু নিয়মিত গড়ে হাজারখানেক চাদর, বালিশের ঢাকা আর অ্যাপ্রন তাতে কাচা হয় না। আর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে যেখানে ওই চাদর-অ্যাপ্রন শুকোতে দেওয়া হয়, সেটি কোনও কাপড় শুকনোর জায়গা হতে পারে না বলে দাবি এলাকার বাসিন্দাদেরই।

Advertisement

স্থানীয় বাসিন্দা মলয় রায় বলেন, ‘‘ওই মাঠে মাঝেমধ্যে ফুটবল খেলা হয়। গরু, ছাগল চরে। সেখানে কী ভাবে হাসপাতালের কাপড় শুকোয়?’’ তবু এ দৃশ্য বাস্তব। ইছাপুর খালপাড়ে হাসপাতালের কাপড় কাচায় ব্যাস্ত প্রশান্ত বাগ বললেন, ‘‘লরি করে হাসপাতাল থেকে কাপড় আসে। কোনও দিন ছ’শো, কোনওদিন হাজার। আমরা অনেক দিন থেকেই বরাত নিয়েছি বি আর সিংহ হাসপাতালের কাপড় কাচার। অত নিয়মকানুন জানি না। পরিষ্কার করি, হাসপাতাল থেকে গাড়ি এলে পাঠিয়ে দিই।’’

কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান এবং এমসিআই (মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া)-এর সদস্য নিলয় সিংহ বলেন, ‘‘হাসপাতালের চাদর থেকে পোশাক— সব কিছুই জীবাণু মুক্ত করার জন্য অত্যাধুনিক ব্যবস্থা থাকার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বেশিরভাগ হাসপাতালেই তা নেই। ফলে সেগুলি বাইরে পাঠাতে হয়। সেখানে কী ভাবে ওই সব চাদর ও পোশাক ধোয়া-কাচা হচ্ছে, তা খেয়াল রাখেন ক’জন?’’

ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ অরিন্দম কর প্রশ্ন তুলেছেন, এমনই যদি হবে, সিএসডি-র ভূমিকা তা হলে কী? তিনি বলেন, ‘‘এক জন জ্বরে আক্রান্তের পোশাক বা বিছানা যে ভাবে জীবাণু মুক্ত হওয়া দরকার, তার থেকে বেশি জীবাণু মুক্ত হওয়া দরকার এক জন এইচআইভি আক্রান্তের পোশাক বা বিছানা। এই গুণমান বজায় রাখার কোনও ব্যবস্থাই নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সুস্থ হতে যাওয়া রোগীদেরও নতুন করে সংক্রমণের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।’’

বি আর সিংহ হাসপাতালের এই কাপড় কাচা ও শুকনোর কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েছেন রেলের আধিকারিকেরাও। পূর্ব রেলের মুখ্য জনস‌ংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘আগে ওখানে কাচতে দেওয়া হতো। এখন আমাদের নিজস্ব আধুনিক ব্যবস্থাতেই হাসপাতালের কাপড় কাচা ও শুকনো হয়।’’

কিন্তু বাস্তব যে অন্য কথা বলছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন