অসুস্থ স্ত্রী তসলিমাকে নিয়ে বিপাকে ঢাকার মহম্মদ সোহেল। শনিবার মুকুন্দপুরে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।
ভিন্ দেশে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে এসে যে আক্ষরিক অর্থেই পথে বসার জোগাড় হবে, তা কল্পনাও করতে পারেননি শাহনওয়াজ হোসেন। ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিলের চক্করে পড়ে এখন তাঁর ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা।
ইএম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালে দেড় সপ্তাহ ধরে ভর্তি রয়েছেন শাহনওয়াজের স্ত্রী। মেয়েকে নিয়ে উঠেছেন হাসপাতালের অদূরে একটি গেস্টহাউসে। খাওয়াদাওয়াও সেখানেই। মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর নোট-বাতিলের ঘোষণার পরে বুধবার সকালে গেস্টহাউসের মালিক জানিয়েছিলেন, অসুবিধে নেই। টাকা দু’দিন পরে দিলেও চলবে। কিন্তু দু’দিন পরে, শনিবারও নোট ভাঙানোর সমস্যা মেটেনি। গেস্টহাউসের মালিক তাই বলে দিয়েছেন, ‘‘আমাকেও তো নিজের সংসার চালাতে হবে। টাকা দিতে না পারলে ঘর ছেড়ে দিন।’’ আতান্তরে পড়ে গিয়েছেন শাহনওয়াজ। এখন কোথায় যাবেন তিনি? তাঁর কথায়, ‘‘হাসপাতালের খরচ কার্ডে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের থাকা-খাওয়ার জন্য নগদ পাব কোথায়? আমার এক ভাইকে টাকা নিয়ে কলকাতায় আসতে বলেছি। কিন্তু ভিসা নিয়ে আসতেও তো সময় লাগবে। তত দিন কী হবে? মালপত্র নিয়ে তো আর হাসপাতালের রিসেপশনে বসে থাকতে পারব না!’’
শাহনওয়াজ একা নন। তাঁর মতোই অবস্থা বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান থেকে আসা অজস্র রোগীর পরিবারের। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া থেকে পূর্ব যাদবপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন আলমগির হোসেন। ছুটি পাওয়ার কথা ছিল গত বৃহস্পতিবার। কিন্তু তার মধ্যেই এই সমস্যা। দেশ থেকে ডলার ভাঙিয়ে নোট নিয়ে এসেছিলেন আলমগিরের আত্মীয়রা। সবটাই প্রায় ৫০০ আর ১০০০-এ। এখন তাঁরা দিশেহারা। হাসপাতালকে দিতে হবে ৫২ হাজার টাকা। নিউ মার্কেটে এক জন টাকা ভাঙিয়ে দেবেন বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেননি। হতাশ হয়ে শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে ভেঙে পড়েন আলমগির। অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত তাঁদের কাছ থেকে ৫০০-১০০০-এর নোট নিতে রাজি হয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আলমগির ও তাঁর সঙ্গীদের কী হবে!
ঢাকার বাসিন্দা মহম্মদ সোহেল তাঁর স্ত্রী তসলিমাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ৯ তারিখ কলকাতায় এসেছেন। পায়ের সমস্যায় ভাল করে হাঁটতে পারেন না তসলিমা। মানি এক্সচেঞ্জার-এর মাধ্যমে ৪ হাজার টাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই টাকা ডাক্তার দেখাতে আর কিছু পরীক্ষা করাতেই খরচ হয়ে গেছে। এখনও ঢের পরীক্ষা বাকি। থাকা-খাওয়ার খরচও নেই। সঙ্গে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে দেশে ফিরতে হচ্ছে তাঁকে। একই দশা ঢাকার খলিলুর রহমানের। ৩৫ বছরের এই যুবক মাঝেমধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসেছেন গত বৃহস্পতিবার। ডাক্তার বলেছেন, এমআরআই করাতে হবে। অথচ সঙ্গে ৫০০-১০০০ হাজার ছাড়া অন্য কোনও নোট নেই। আজ, রবিবার সকালের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ঢাকায় ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য উপায় দেখছেন না খলিলুর।
ফরিদপুরের বাসিন্দা মুস্তাফিজুর আলি জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে মেয়ের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এসেছেন। মেয়ে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু তার চিকিৎসার খরচ কী ভাবে জোগানো যাবে মুস্তাফিজুর জানেন না। কারণ, সেই একই। হাসপাতালের উল্টো দিকে যে লজে উঠেছেন, সেখানকার ভাড়া দিতে পারেননি। হাতে লক্ষাধিক টাকা থাকা সত্ত্বেও খাবার কিনতে পারছেন না। খুচরো যা রয়েছে, তা দিয়ে দু’দিন ঘরে শুধু পাউরুটি আর বিস্কুট খেয়ে আছেন। অথচ চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থাকবে বলে ফিরেও যেতে সাহস পাচ্ছেন না।
বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্রতি মাসে গড়ে প্রায় শ’পাঁচেক বাংলাদেশি রোগী চিকিৎসার জন্য এ দেশে আসেন। তাঁদের একটা বড় অংশ আসেন বাইপাসের ধারের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে। এঁরা অনেকেই নগদ ভারতীয় টাকা নিয়ে আসেন। বাইপাসের এক হাসপাতাল কর্তার কথায়, ‘‘কিছু বাংলাদেশি, নেপালি ও ভুটানি রোগী ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর করছেন। আমরা চেকও নিচ্ছি, কার্ডও নিচ্ছি। সমস্যা হচ্ছে কেউ নগদে ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট দিলে। সেটা তো আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়।’’
এই পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের দফতর থেকে সমস্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিককে একটি লিখিত অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে। টাকার জন্য যাতে কোনও বাংলাদেশি রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত না-হয়, সেটা যেন হাসপাতালগুলি দেখেন। কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব, তা খোলসা করে অনুরোধপত্রে বলা হয়নি বলে অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বিভ্রান্ত। মুকুন্দপুরের এক হাসপাতালের কর্তা জানান, কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা এখনও কোনও কোনও বিদেশি রোগীর থেকে ৫০০-১০০০ টাকার নোট নিচ্ছেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না। টাকা নিয়ে সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশিদের অনেকেই হাসপাতালের বাইরে দালালের খপ্পরে পড়ছেন বলে অভিযোগ। এই দালালরা ৫০০-র নোট বদলে দিচ্ছেন ৪০০ টাকা। বড় নোটে ৫ হাজার টাকা দিলে মিলছে ৪৫০০ টাকা। উপায় না দেখে অনেক বাংলাদেশি রোগীর পরিবার এদেরই দ্বারস্থ হচ্ছেন।