চলছে বিস্ফোরণের তদন্ত। মোটর স্ট্যান্ড এলাকায়। —নিজস্ব চিত্র।
পাহাড় এমনিতেই তাড়াতাড়ি ঘুমোয়। তাই মাঝরাতে বিস্ফোরণের ঝাঁকুনিকে ঘুমের ঘোরে পলদেন লামা, রিমা ভুটিয়া, সাংদেন লেপচার মতো অনেকে ভেবেছিলেন, আবার বোধ হয় ভূমিকম্প! ওঁরা সকলেই চকবাজার লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা। তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই তাঁরা বুঝতে পারেন, চারদিক অন্ধকার। লোডশেডিং। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের গাড়ির হুটারের আওয়াজ, দমকলের ঘণ্টা, ভারী বুটের শব্দে সরগরম হয়ে ওঠে নিস্তব্ধ পুরনো সুপার মার্কেট। টর্চ বা মোবাইলের আলো জ্বেলে যাঁরা গুটি গুটি বাইরে উঁকি দিয়েছিলেন, তাঁদের নাকে এসে লাগে বারুদের গন্ধ।
শুক্রবার রাতে কেউ দুচোখের এক করতে পারেননি। বরং, বয়স্কদের কাছে ১৯৮৬-৮৭ সালের রক্তাক্ত সংঘর্ষের কথা শুনতে শুনতে আতঙ্কে-উদ্বেগে রাত জেগেছে দার্জিলিং।
আরও পড়ুন: পরের পর বিস্ফোরণ বাড়াল দ্বন্দ্ব
ভোরের আলো ফুটতে সেই আতঙ্কের ছবিই দেখা গেল জনে-জনে। শুক্রবার অবধি যিনি মোর্চার মিছিলে পা মিলিয়েছেন, সেই দোকান-মালিক কিংবা সরকারি চাকুরেদের অনেকেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘‘এ তো যুদ্ধের আয়োজন! এ সবের মধ্যে থাকতে পারব না। মিটিং-মিছিল, ধর্না, অবস্থান করতে পারি। তা বলে যুদ্ধ নয়।’’ যা শোনার পরে মোর্চার মাঝারি মাপের নেতারা কোনও প্রতিবাদ করেননি। বরং, নিজেরাও অস্বস্তি এড়াতে বারবারই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, এ সবের সঙ্গে তাঁদের দল যুক্ত নয়। কিন্তু, মোর্চার কোনও প্রথম সারির নেতা ঘটনাস্থলের ধারেকাছে যাননি। পরে দুপুরে টেলিফোনে মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা বিনয় তামাঙ্গ বলেছেন, ‘‘পাহাড়বাসীর শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে থামাতে চক্রান্ত হচ্ছে। সেটা আমরা ব্লক, গ্রাম স্তরের নেতাদের মাধ্যমে পাহাড়বাসীদের বোঝাচ্ছি। সকলেই বুঝছেন।’’ তার পরে সন্ধ্যায় বিবৃতি দিয়ে বিমল গুরুঙ্গ জানান, তাঁদের বিপদে ফেলতে চেষ্টা চালাচ্ছে অন্য কোনও শক্তি।
পাহাড়বাসীরা মোর্চা নেতাদের এই কথায় হইহই করে সমর্থন করছেন, এমন কিন্তু এ দিন দেখা যায়নি। বরং, শনিবার অনেকেই ঘটনাস্থলের আশেপাশে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেছেন, ৬৮ দিন ধরে বন্ধ চললে ঘর-সংসার যে অচল হয়ে পড়ে, সেটা নেতারা কবে বুঝবেন! কেউ জানালেন, বাবা হার্টের রোগী। চিকিৎসার জন্য মাসে যে খরচ হয়, সেই টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। তা তোলা হবে কী করে? ব্যাঙ্ক-এটিএম তো বন্ধ! কারও ছেলেমেয়েকে অন্যত্র ভর্তি করানোর টাকা নেই। কেউ খেতে স্কোয়াশ, আলু হওয়া সত্ত্বেও তা বিক্রি করতে পারছেন না। কয়েক জন মোমো ব্যবসায়ী জানালেন, তাঁরা আর এক সপ্তাহ দেখে শিলিগুড়িতে নেমে গিয়ে স্টল খোলার চেষ্টা করবেন। তাঁদের অনেকেরই ভয়, জিএনএলএফ আমলে যেমন গোলাগুলি চলত পাহাড়ে, ফের না তেমন কিছু শুরু হয়!
১৯৮৬ সাল থেকে টানা দু’বছর পাহাড়ে সুবাস ঘিসিঙ্গ আন্দোলন চালিয়েছিলেন। তখন একাধিকবার ল্যান্ডমাইনের ব্যবহার হয়েছে। গ্রেনেড হামলা হয়েছে ডিআইজি আর কে হান্ডার গাড়ি লক্ষ করেও।
এ সব ভেবেই এখন ঘুম ছুটেছে পাহাড়ের।