জমি বদল
Nandigram

রাজনীতির তরজার মাঝে আক্ষেপ ছাপিয়ে শিল্পের দাবি

নন্দীগ্রামে এখন অনেক চাষজমিতে ভেড়ির রমরমা। উঠছে শিল্পের দাবিও।এলাকায় শিল্প যে জরুরি, তা প্রকারান্তরে মানছেন তৃণমূলের নন্দীগ্রাম বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান মেঘনাদ পালও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২০ ০৩:৩৩
Share:

দিগন্তবিস্তৃত এই সব জমিতেই গড়ে উঠেছে ভেড়ি। নন্দীগ্রাম ২ ব্লকে। নিজস্ব চিত্র

প্রায় দেড় দশক আগে চাষ বাঁচাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল যে মাটি, সেখানে এখন শোনা যায় আফশোসও। সেই আক্ষেপ যেমন কৃষিতে পর্যাপ্ত উন্নতি না হওয়ার, তেমনই শিল্প না হওয়ারও বটে।

Advertisement

নন্দীগ্রামের মৎস্যজীবী সংগঠন সূত্রে খবর, গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার একর ধান জমি মাছের ভেড়ির জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা ২০০৭-০৮’এর লড়াকু সময়ে ধান জমিতে কারখানা হতে দেবেন না বলে আন্দোলন করেছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নন্দীগ্রামের এক কৃষকের কথায়, ‘‘কৃষিজমি বাঁচাতে জীবন বাজি রেখেছিলাম। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় এসে এলাকায় কৃষির উন্নয়নের দিকে তেমন ভাবে তাকাল না। এখন মনে হচ্ছে কৃষি নির্ভর বা অন্য কোনও শিল্প হলে অন্তত পরিবারের একজনও চাকরি পেত। সবাই খেয়ে-পরে বাঁচত।’’ নন্দীগ্রামের কৃষক পরিবারের বেকার যুবক-যুবতীরা এখন কাজের খোঁজে শিল্পশহর হলদিয়ায় যান, না হলে কলকাতা, কিংবা ভিন্‌ রাজ্যে।

এলাকায় শিল্প যে জরুরি, তা প্রকারান্তরে মানছেন তৃণমূলের নন্দীগ্রাম বিধানসভা কমিটির চেয়ারম্যান মেঘনাদ পালও। তিনি বলেন, ‘‘জল-রাস্তাঘাট-বিদ্যুৎ সবই হয়েছে। আর কৃষি নির্ভর শিল্প স্থাপনের ভাবনাও রয়েছে সরকারের। রাজ্য সরকারের কাছে সেই দাবি জানানো হয়েছে।’’

Advertisement

নন্দীগ্রামের অনেকেরই আরও ক্ষোভ এই দেখে যে, জমি আন্দোলনের পুরোভাগে থাকা তৃণমূলের বহু নেতারই আজ ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের বর্তমান সহ-সভাধিপতি শেখ সুফিয়ানের পেল্লায় ‘জাহাজ বাড়ি’ দেখে তো খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সেই সুফিয়ান ভেড়ির রমরমার জন্য আবহাওয়া পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাঁর মতে, নন্দীগ্রামে আগে দুই ও তিন ফসলি জমি ছিল। এখন সারা বছর বৃষ্টি হয়। তাই চাষে লাভ কম হচ্ছে। অনেকে মাছ চাষের দিকে চলে যাচ্ছেন। এই যুক্তি উড়িয়ে হলদিয়ার কৃষি আধিকারিক দেবায়ন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শেষ দু’তিন বছরে আবহাওয়ার এমন কোনও পরিবর্তন হয়নি যাতে কৃষিকাজ করা যাবে না।’’

আরও পড়ুন: দলবাজি, বঞ্চনা চলবে না: সর্বদল বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী

স্থানীয় তৃণমূল শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যা, ধানের মতো মাছও তো এক প্রকার চাষই। ফলে একে চাষের চরিত্র বদল বলা চলে। তবে কৃষিজমির ভোল পাল্টে ভেড়ি বানানো যে ক্ষতিকর, তা মনে করিয়ে দিচ্ছে কৃষি দফতর। জেলা কৃষি দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর আশিস বেরা বলেন, ‘‘যে ভাবে ভেড়ি বাড়ছে, তাতে খাদ্য ও পানীয় জলের সঙ্কট হবে। ভেড়িতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করা হচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে চাইলেও আর কৃষিকাজ হবে না। কারণ, রাসায়নিকে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে।’’ তাঁর সংযোজন, যেখানে সমুদ্রের নোনা জল ভেড়িতে ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ হচ্ছে, সেখানেও মাটি চাষের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। সাপ, ব্যাঙ নিরাশ্রয় হয়ে জীববৈচিত্রে প্রভাব পড়ছে।

জমি-বদলের তথ্য সামনে রেখে সুর চড়াচ্ছে বিরোধীরাও। সিপিএমের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি বলেন, ‘‘নন্দীগ্রামে কৃষকদের আবেগেকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূল তাঁদের শুধু ব্যবহার করেছে। মানুষ আজ তা টের পাচ্ছেন।’’ বিজেপির তমলুক সাংগঠনিক জেলা সভাপতি নবারুণ নায়েকের কটাক্ষ, ‘‘তৃণমূল একটাই শিল্প বোঝে— কাটমানির শিল্প।’’

তরজার মাঝেই আফশোস বাড়ছে নন্দীগ্রামে। জমি আন্দোলনের সময় নিতান্তই কিশোর নন্দীগ্রাম ২ ব্লকের দেবব্রত দাস এখন যুবক। বছর ছাব্বিশের দেবব্রত রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন চেন্নাইয়ে। করোনা-কালে ফিরেছেন। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘শিল্প হলে হয়তো বাইরে যেতে হত না। পরিযায়ী, করোনা এক্সপ্রেসের খোঁচাও সইতে হত না।’’ (শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement