ভয় ভুলে রুখে দাঁড়াতেই পিঠটান সন্ত্রাসের

ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই চলছিল ‘চড়াম-চড়াম’। চলছিল জরিমানা আদায়। চলছিল বাড়ি ভাঙচুর। ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলেন গ্রামবাসী। কিন্তু সোমবার এক বৃদ্ধা আক্রান্ত হতেই হাতে হাত মেলালেন গ্রামের সবাই। ভুলে গেলেন কে সিপিএম, কে কংগ্রেস, কে তৃণমূল! রাতারাতি গড়ে ফেলা হল ‘গ্রাম রক্ষী বাহিনী’।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রকাশ পাল

তারকেশ্বর শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৬ ০৩:৪০
Share:

হামলাকারীদের ঠেকাতে একজোট আসতারা গ্রাম। ছবি: সুশান্ত সরকার

ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই চলছিল ‘চড়াম-চড়াম’।

Advertisement

চলছিল জরিমানা আদায়। চলছিল বাড়ি ভাঙচুর।

ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলেন গ্রামবাসী। কিন্তু সোমবার এক বৃদ্ধা আক্রান্ত হতেই হাতে হাত মেলালেন গ্রামের সবাই। ভুলে গেলেন কে সিপিএম, কে কংগ্রেস, কে তৃণমূল! রাতারাতি গড়ে ফেলা হল ‘গ্রাম রক্ষী বাহিনী’। আর সেই বাহিনীর ভয়েই তারকেশ্বরের আসতারা-দত্তপুর পঞ্চায়েতের পূর্ব আসতারা গ্রাম থেকে পিঠটান দিয়েছে সন্ত্রাস। গত দু’দিনে কোনও গোলমাল হয়নি। এমনকী, জরিমানার টাকাও ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছে হামলাকারীরা! বাহিনীর মহিলা-পুরুষেরা পালা করে রাত-পাহারাও শুরু করেছেন।

Advertisement

ভোটের ফল বেরনোর পরে শান্তি বজায় রাখার জন্য হাওড়ার আমতার কুমারিয়া গ্রামে তৃণমূল ও বিরোধী নেতারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন, গ্রামে গোলমাল চলবে না। বীরভূমের ইলামবাজারে তৃণমূল লিফলেট বিলি করে দলের কর্মীদের সংযত থাকার বার্তা দিয়েছে। কিন্তু ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাস ঠেকাতে আসতারা-দত্তপুরের মতো গোটা গ্রামের একজোট হয়ে রাস্তায় নামার উদাহরণ এর আগে সামনে আসেনি। এমনকী, তারকেশ্বরেরই মালপাহাড়পুর, বালিগোড়ি বা চাঁপাডাঙা গ্রামে সন্ত্রাস এখন অব্যাহত।

কিন্তু কারা হামলা চালাচ্ছিল পূর্ব আসতারায়? গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ, তৃণমূলেরই একটি গোষ্ঠীর কিছু ছেলে। প্রচার পর্বে ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে’ বুঝে নেওয়ার ‘বার্তা’ দিয়েছিলেন খোদ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফল প্রকাশের যেন সেই ‘বুঝে নেওয়া’ শুরু হয়েছিল।

কেমন সেই ‘বুঝে নেওয়া’? ১৯ মে ভোটের ফল প্রকাশ হওয়ার পরে রাতেই গ্রামে বিরোধী দলের একের পর এক কর্মী-সমর্থকের বাড়িতে হামলা হয়। অভিযোগ, শুক্রবার রাতে অসিত সামন্ত নামে এক প্রাক্তন সিপিএম কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। অসিতবাবুকে বেধড়ক মারধরও করা হয়। পরের রাতে গ্রামের মনসাতলার কাছে একটি বাড়িতে চড়াও হয় হামলাকারীরা। গৃহকর্তার ‘অপরাধ’, বামপ্রার্থী সঙ্গীদের নিয়ে যখন প্রচারে এসেছিলেন, তখন তাঁদের জল-বাতাসা খাইয়েছিলেন তিনি। গৃহকর্তা এবং তাঁর স্ত্রীকে মারধর করা হয়। হামলাকারীরা ২০ হাজার টাকা দাবিও করে বলে অভিযোগ। গৃহকর্ত্রী বলেন, ‘‘ধার করে ৫ হাজার টাকা
দিয়ে তখনকার মতো রেহাই মিলেছিল। ওদের হাতে-পায়ে ধরে বারবার বলি, আমরা তোমাদেরই ভোট দিয়েছি। তা-ও কোনও কথা শুনতে চায়নি।’’

গত শনিবার সিপিএম কর্মী মহাদেব জানার বাড়িতেও হামলা হয় এবং এক লক্ষ টাকা দাবি করা হয় বলে অভিযোগ। জয়দেববাবুর স্ত্রী এবং বড় বৌমা একজোড়া কানের দুল এবং আংটি খুলে দেন। পরিবারের লোকেদের দাবি, ‘‘পরের দিন সুদে ২০ হাজার টাকা নিয়ে তৃণমূলের কার্যালয়ে দিয়ে আসতে হয়।’’

পর পর এই ঘটনায় গ্রামে আতঙ্ক এতটাই ছড়িয়েছিল যে হামলার ভয়ে ছোট ছেল‌েমেয়েদের সন্ধ্যার পরে বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না। সবাইকে ঘরে খিল এঁটে বসে থাকতে হচ্ছিল। কিন্তু সোমবার এক বৃদ্ধা আক্রান্ত হওয়ার পরেই পাল্টে গেল গ্রামের ছবিটা। গ্রামের মনসাতলায় সকলে বৈঠকে বসেন। ঠিক হয়, হামলাকারীদের কাছে নতিস্বীকার নয়, রুখে দাঁড়াবেন সবাই। ওই রাতেই গ্রামবাসীরা তক্কে-তক্কে ছিলেন। ৯টা নাগাদ হামলাকারীদের এক জনকে দেখে তাড়া করেন তাঁরা। তারপরেই রাত-পাহারার সিদ্ধান্ত হয়। পুরুষদের পাশাপাশি বেরিয়ে আসেন মহিলারাও। হামলাকারীদের নামে পুলিশে লিখিত অভিযোগও জমা হয়।

গত দু’দিনে গ্রামে কোনও হামলা হয়নি। গ্রামে মদরে আসরও বসতে দেখেননি গ্রামবাসীরা। মহাদেববাবু তো আরও অবাক। তাঁর কথায়, ‘‘জরিমানার ২০ হাজার টাকাই ওরা ফেরত দিয়ে গিয়েছে মঙ্গলবার রাতে। পুরো ভাল ছেলের মতো। ভাবা যায়!’’ গ্রাম রক্ষী বাহিনীর সামনের সারিতে থাকা কয়েক জন বলেন, ‘‘আসলে টাকা আদায়ের জন্যই যা খুশি তাই করছিল ওরা। ওরা অন্য দল থেকে তৃণমূলে ভিড়েছে।’’ কী বলছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? দলের হুগলি জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্তও গ্রামবাসীদের একজোট হওয়ার কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, ‘‘কারও উপরেই হামলা করা যাবে না। দলের রাজ্য নেতৃত্বের এই নির্দেশ যারা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে দলগত ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন