অস্ত্র: তৈরি হচ্ছে নিমাস্ত্র। মহিলারা ব্যস্ত দৌলতপুরে। নিজস্ব চিত্র
প্রথমে প্রয়োগ করা হচ্ছে ‘নিমাস্ত্র’। কাজ না হলে প্রয়োগ করা হয় ‘আগ্নেয়াস্ত্র’। কিন্তু তাতেও হল না কাজ। তখন শেষ অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। আনাজ চাষে কীট দমন করতে জৈব উপকরণ দিয়ে তৈরি এমনই সব অস্ত্র বা কীটনাশক ব্যবহার করে চাষের খরচ একেবারেই কমিয়ে ফেলেছেন মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের দৌলতপুর গ্রামের কয়েকটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। বিঘার পর বিঘা পুরোপুরি জৈব পদ্ধতিতে আনাজ চাষ করে ছ’মাসে মধ্যে লাভেরও মুখ দেখতে শুরু করেছেন মহিলারা। এক জমিতেই বাহারি আনাজের চাষ করছেন তাঁরা। আনাজের কারবারিরা একেবারে জমি থেকেই সেই আনাজ কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছেন বাজারে। সূত্রের খবর, এ বার ওই মহিলাদের উত্পাদিত জৈব আনাজ পড়তে চলেছে এলাকার স্কুলগুলির পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলের পাতেও।
মালদহের গ্রামোন্নয়ন সেল সূত্রে জানা গিয়েছে, ক্রমাগত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে মাটির উর্বরতা শক্তি কমতে শুরু করেছে। সেই সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে উত্পাদিত আনাজের পুষ্টিগুণ নিয়ে উঠছে প্রশ্ন, বিভিন্ন রোগে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। এই রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমাতেই জেলায় কমিউনিটি ম্যানেজড সাসটেনেবল এগ্রিকালচার প্রকল্পে আনাজ চাষ শুরু করা হয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের দিয়ে। প্রাথমিক ভাবে জুন মাস থেকে জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর ২ ব্লকের দৌলতপুর পঞ্চায়েতের দৌলতপুর, মালিওর ১ পঞ্চায়েতের অর্জুনা ও সুলতাননগর পঞ্চায়েতের সুলতাননগর গ্রামে সেই প্রকল্পে চাষ করা শুরু হয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের জমিতেই চলছে এই চাষাবাদ। তিনটি গ্রামে মোট সাড়ে সাতশো একর জমিতে সেই চাষ হচ্ছে বলে খবর।
দৌলতপুর গ্রামে ৩০০ একর জমিতে মহিলা স্বাধীন সমবায় সমিতি নামে সঙ্ঘের অধীনে থাকা ৪২টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা কৃষিকাজ করছেন। একই জমিতে আলুর পাশাপাশি ফলানো হচ্ছে বেগুন, মূলো, সরষে, পালং শাক, ধনেপাতা থেকে শুরু করে ওলকপি, ফুলকপি ও বাঁধাকপিও। কোনও কারণে একটি আনাজ চাষে ক্ষতি হলে অন্য আনাজে সেই মার পুষিয়ে নেওয়া যাবে বলেই একই জমিতে এ হেন বাহারি আনাজ চাষের উদ্যোগ।
হরিশ্চন্দ্রপুর ২ ব্লকের ব্লক প্রজেক্ট ম্যানেজার দ্বিজেন্দ্র দাস বলেন, ‘‘গোবর, গোমূত্র, কেঁচো সারের মতো জৈব সার দিয়েই মহিলারা চাষাবাদ করছেন। চাষে কোনও রোগপোকার আক্রমণ হলে তা দমন করা হচ্ছে জৈব উপায়েই। ব্যবহার হচ্ছে নিমাস্ত্র থেকে ব্রহ্মাস্ত্র।’’
কিন্তু কী সেই নিমাস্ত্র? স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এক সদস্য পূর্ণিমা সিংহ বলেন, ‘‘নিমাস্ত্র একটি কীটনাশক। নিম গাছের পাতা বাটা, গোবর, গোমূত্র দিয়ে এটা তৈরি করা হয়। আনাজে কোনও রোগপোকার আক্রমণ হলে প্রাথমিক ভাবে সেটাই জলে গুলিয়ে স্প্রে করা হয় গাছে। তাতে কাজ না হলে আগ্নেয়াস্ত্র হিসেবে কাঁচালঙ্কা, রসুন, নিমপাতা, গোমূত্রর মতো জিনিস দিয়ে তৈরি কীটনাশক স্প্রে করা হয়। শেষে ব্রহ্মাস্ত্র।’’ তিনি বলেন, ‘‘আগে রাসায়নিক সার বা রাসায়নিক মেশানো কীটনাশক ব্যবহার করে যা খরচ হত, এখন জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহারে খরচ অনেকটাই কম হয়। এ ভাবে উৎপন্ন করা আনাজ স্বাস্থ্যসম্মতও। বাজারে এই আনাজের দাম আমরা ভালই পাচ্ছি।’’
জেলা গ্রামোন্নয়ন সেলের প্রকল্প আধিকারিক প্রশান্তকুমার গুহ বলেন, ‘‘জৈব আনাজ চাষে উত্সাহ বাড়াতেই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের মাধ্যমে এই উদ্যোগ জেলায় শুরু করা হয়েছে।’’
মিড-ডে মিল প্রকল্পের জেলা আধিকারিক পূর্বিতা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ বার ওই জৈব আনাজ আমরা স্থানীয় সমস্ত স্কুলের পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলের জন্য ব্যবহার করব।’’