জাতীয় পতাকা হাতে এক পায়েই এগিয়ে চলেছেন উদয়। ছবি: সংগৃহীত।
ঠিক ১০ বছর আগের ঘটনা। সুস্থসবল ছেলেটি ফিরছিলেন কারখানার কাজ সেরে। কথা ছিল আগরপাড়া স্টেশনে নেমে বাড়ি যাবেন। কিন্তু চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে চিরতরে চলে যায় তাঁর বাঁ পা। মুহ্যমান হয়েছিলেন। ভেঙেও পড়েছিলেন। কিন্তু আবার উঠেও দাঁড়িয়েছেন। এক পায়েই। শুধু উঠে দাঁড়াননি। বিরল কীর্তি ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। কিন্তু জোটেনি সরকারি সহায়তা।
আপাতত তাঁর বয়স ৩৫। কলকাতা লাগোয়া কামারহাটির ২৯ নম্বর নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তরুণের নাম উদয় কুমার।
পর্বতশৃঙ্গ জয়ের পর উদয়। ছবি: সংগৃহীত।
এক পায়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন উদয়। গত চার-পাঁচ বছরে দেশের ১৭টি রাজ্যে প্রায় ৯০টি ম্যারাথনে দৌড়েছেন। এক পায়েই। ম্যারাথনের রাজপথ থেকে আরও উপরে যেতে চেয়ে শুরু করেন পর্বতারোহণ। প্রথমে সান্দাকফু। ১২,৫০০ ফুট। সান্দাকফুর সাহস নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের ১৬,৫০০ ফুট একটি শৃঙ্গবিজয়। থামেননি। ২০২৪ সালে অভিযান ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো অভিযান। ১৯,৩৪১ ফুট উচ্চতর কিলিমাঞ্জারো জয় করার পর দক্ষিণ আফ্রিকার আকাশ এবং জলে রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন (বাঁ দিকে) উদয় কুমার। ছবি: সংগৃহীত।
দার এস সালামে জলের নীচে স্কুবা ডাইভিং করেছেন। তার পর দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য একটি শহরে ১৩ হাজার ফুট স্কাইডাইভ করেছিলেন। বিশেষ ভাবে সক্ষম প্রথম ভারতীয় হিসাবে জল, স্থল এবং আকাশ অভিযানের নজির গড়েছেন উদয়। সে কারণেই চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলেন কামারহাটির এই তরুণ।
রাষ্ট্রপতি ভবনের যে অনুষ্ঠানে পুরস্কার পেয়েছিলেন উদয়, সেই অনুষ্ঠানেই সম্মান পেয়েছিলেন অলিম্পিকে পদকজয়ী মনু ভাকের, প্যারালিম্পিক্সে সোনা জয়ী জ্যাভেলিন থ্রোয়ার নভদীপ সিংহরা। উদয়ের আক্ষেপ, ‘‘ওঁরা সকলেই নিজেদের রাজ্যের সরকারের সহায়তা পেলেন, চাকরি পেলেন। আমারই কিছু হল না। সবই কপাল!’’ উদয়ের আরও খেদ যে, এলাকার কাউন্সিলরও পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করেননি।
সংস্কৃত শ্লোকে আছে ‘পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্’। অর্থাৎ পঙ্গুও চাইলে মনের জোরে পাহাড় চড়তে পারে। উদয় কি সেই শ্লোকের কথা জানেন? না। তিনি গীতা জানেন। মানেনও। তাই মানেন, ‘যা হয়েছে ভাল হয়েছে। যা হচ্ছে ভাল হচ্ছে। যা হবে ভাল হবে।’ আপাতত একটি রং প্রস্তুতকারক সংস্থায় বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করেন উদয়। ক্রাচে ভর করেই ট্রেনে-বাসে করে ঘোরেন বাজারে। বাবা প্রয়াত হয়েছেন ২০১৩ সালে। দুর্ঘটনায় পুত্রের পঙ্গু হয়ে যাওয়া সহ্য করতে না পেরে অল্প দিনের মধ্যেই চলে যান মা-ও। স্ত্রী এবং তিন সন্তান আছে বাড়িতে। সংসার, সন্তানদের পড়ার খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন উদয়। তবে এ হেন অনিশ্চয়তার মধ্যেও উদয় স্বপ্ন দেখছেন এভারেস্ট জয়ের। তার আগে আগামী বছর পর্বতারোহণে যাবেন লাদাখে। বলছেন, একবার উঠে যখন দাঁড়িয়েছেন, তখন আর হারতে চান না। থামতে চান না। নিজেই নিজের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করছেন অভিযানের জন্য।
‘পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্’ সংস্কৃত শ্লোক জানেন না। কিন্তু পাহাড় টপকানোর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন এক পায়েই!