একরথে: সারথি রেজ্জাক। রামের সাজে তারিক ইসলাম। রবিবার রামপুরহাটে। —নিজস্ব চিত্র।
চারদিকে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি। রামপুরহাট শহরের ব্যস্ততম পাঁচমাথা মোড়ের দিকে রবিবার দুপুরে এগিয়ে চলেছে রামনবমীর শোভাযাত্রা।
বেলা একটা নাগাদ পাঁচমাথা মোড়ে থামল একটি সুসজ্জিত রথ। ঘোড়ায় টানা সেই রথের সারথি নীচে দাঁড়িয়ে। মুখ ভর্তি কাঁচা পাকা দাড়ি। মাথায় সাদা কাপড়ের পাগড়ি। রথে রাম-সীতা বসে আছেন। সারথির নাম সেন্টু ওরফে রেজ্জাক শেখ। বাড়ি মুর্শিদাবাদের সমশেরগঞ্জ থানার বাবুপাড়ায়। সেই রথে রাম হয়েছেন যিনি, তাঁর নাম তারিক ইসলাম। পাশে সীতা অঞ্জলি দাস।
রামনবমী ঘিরে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যেখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, সেখানে রামপুরহাটের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের রেলপাড় বজরংবলী পুজো কমিটির রামরথ অন্য বার্তা বয়ে আনল। বোঝাল, রাম হোক বা রহিম— ধর্ম কোনও উৎসব পালনের বেড়া হতে পারে না।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
রেজ্জাক জানালেন, বাপ-ঠাকুরদার ব্যবসা ধরে রেখে বাড়িতে দু’টি ঘোড়া পুষে রেখেছেন। বিয়েবাড়ির শোভাযাত্রা হোক বা ঠাকুরপুজোর শোভাযাত্রা, রথের ঘোড়ার জোগান দেওয়াটাই হচ্ছে বছর পঞ্চান্নর রেজ্জাকের পেশা। রামনবমীর শোভাযাত্রার জন্য বজরংবলী পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা মাসখানেক আগে ঝাড়খণ্ডের পাকুড়ের এক প্যান্ডেল ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ওই ব্যবসায়ী ঘোড়া চান রেজ্জাকের কাথ থেকে। রামসীতার রথের সারথি হতে হবে জেনেই রবিবার ভোরেই নিজের বছর চোদ্দোর ছেলে সহিদুলকে নিয়ে রামপুরহাট পৌঁছে যান রেজ্জাক। ভিড়ে ঠাসা পথে রথ যখনই দাঁড়িয়ে পড়েছে, তখন ছেলেকে সারথির আসনে বসিয়ে রেজ্জাক রথ থেকে নেমে নিজের ঘোড়া সামলেছেন স্নেহের সঙ্গে।
রেজ্জাক বলছিলেন, ‘‘তফাৎটা কোথায় জানেন? মানুষের মনে। মা আর বাবার মধ্যে তফাৎ আছে। আছে ভাই-বোনেরও। কিন্তু, আমরা কি সেটা কখনও মাথায় রাখি?’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এই তো শনিবার দেওঘরে একই জিনিস করে এলাম। গত বছর বর্ধমানে এই উৎসবেই চারটে রথে ঘোড়ার জোগান দিয়েছিলাম। সব জায়গাতেই মানুষের ভালবাসা পেয়েছি।’’
রেজ্জাকের রথের রাম তারিক ইসলাম ওরফে সাদ্দামও একই কথা বলছেন। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের রেলকলোনির যুবক তারিক মডেলিং করেন। এক সময় রামপুরহাট কলেজের এসএফআই পরিচালিত ছাত্র সংসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তারিকের কথায়, ‘‘আমি মডেল। অনেক দিন থেকেই রামের ভূমিকায় মডেলিং করার ইচ্ছে ছিল। এ বার উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে দ্বিতীয় বার ভাবিনি।’’ সীতা যে হয়েছে, দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সেই অঞ্জলি বলেন, ‘‘সম্প্রীতির এই পরিবেশটাই সবচেয়ে ভাল লেগেছে।’’
রেজ্জাক বা তারিকই কেন?
এ প্রশ্ন শুনে বজরংবলী পুজা কমিটির পক্ষে সুনীল প্রসাদ, চিন্টু বীরবংশি, অমিত প্রামাণিকেরা বললেন, ‘‘রাম বিশ্ব মানব। তাঁর কোনও জাতপাত নেই। আমরা চেয়েছিলাম রামনবমীর শোভাযাত্রায় যেন কোনও ভাবেই রাজনীতি বা ধর্মের রং না লাগে। বাস্তবে তা করতে পেরে এবং উৎসবের দিনে মানুষকে আনন্দ দিতে পেরে ভাল লাগছে।’’ সুনীল বিজেপি-র রামপুরহাট মণ্ডল কমিটির সদস্য। চিন্টু দলের যুবমোর্চার নেতা। দু’জনেরই বক্তব্য, ‘‘রামের ভূমিকায় তারিক, সীতার ভূমিকায় অঞ্জলি দাস আর রথের সারথি রেজ্জাক। এটাই তো সম্প্রীতি!’’
রেজ্জাক নিজেও বলছেন, ‘‘উৎসবের আনন্দে সবার যোগদান করতে অসুবিধা কোথায়?’’