সাগর থেকে ফেরার পথে কচুবেড়িয়ায় মারা গেলেন তিন পুণ্যার্থী। আর সেই নিয়ে নতুন করে দ্বন্দ্ব তৈরি হল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে।
মকর সংক্রান্তির স্নান হয়ে গিয়েছিল শনিবারেই। রাতটা মেলায় কাটিয়ে এ দিন ঘরে ফেরার পথে অনেকেই অপেক্ষা করছিলেন কচুবেড়িয়ার জেটি ঘাটে। ৪ এবং ৫ নম্বর জেটিতে ভিড় ছিল অন্যগুলির থেকে বেশি। জোয়ার না হলে মুড়িগঙ্গায় ভেসেল চলে না। পুণ্যার্থীরা দীর্ঘক্ষণ জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ভেসেল আসার পরে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। তখন ধাক্কাধাক্কিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিন জন। পরে তাঁদের মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
এই ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইট করে জানান, তিনি পশ্চিমবঙ্গে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শোকাহত। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় (পিএমও) সূত্রে বলা হয়, মৃতদের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে এবং জখমদের ৫০ হাজার টাকা করে এককালীন অনুদান দেবে কেন্দ্রীয় সরকার।
পিএমও-র এই টুইটে রাজ্য রাজনীতিতে রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়। তিনটি মৃত্যুর খবর ততক্ষণে শাখাপ্রশাখা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল সাইটগুলিতে। কোথাও কোথাও এমনও রটে যায় যে, জেটি ভেঙে গিয়েছে। কোথাও আবার বলা হয়, ব্যারিকেড ভেঙে পদপিষ্ট হয়েছেন ছ’জন। এমন সব খবর কানে যেতে রাতেই ফের কচুবেড়িয়া যান মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। এত দিন ধরে বিজেপি এবং তৃণমূলের মধ্যে যে টানটান স্নায়ুর লড়াই চলছে, তাতে নতুন করে ঘৃতাহুতি পড়ে।
রাজ্য সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব জানান, কচুবেড়িয়ার ঘটনার পরে কেন্দ্রীয় সরকারের কেউ রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা সত্যি কি না, তা নিয়ে খোঁজও নেওয়া হয়নি। তা হলে তাঁরা কী করে জানতে পারলেন, ভিড়ের চাপে পায়ের তলায় পড়েই পুণ্যার্থীদের মৃত্যু হয়েছে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় রীতিনীতি বারবার ভাঙার’ অভিযোগ করে আসছেন। এ দিন আর এক বার তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা একই অভিযোগ তুলেছেন।
ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনাই ঘটেনি। যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁরা হয় বয়স নয়তো অসুস্থতার জন্য মারা গিয়েছেন।’’ এই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ‘‘তা হলে কাল (শনিবার) সাগরে যিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তিনিই বা কেন্দ্রীয় সরকারি অনুদান পাবেন না কেন?’’ তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘‘মৃত্যু নিয়ে এ ভাবে রাজনীতি করা উচিত নয়।’’
কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ না করে কী ভাবে এই তথ্য পেল, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলে আবাসনমন্ত্রী এবং তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘রাজ্যকে এড়িয়ে এ সব এ ভাবে বলা যায় নাকি? কেন্দ্রের দায়িত্বশীল সরকার এক বার রাজ্যের সঙ্গে কথা বলবে না?’’ তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ, ‘‘আসলে মেরুকরণের রাজনীতি করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।’’
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পিবি সালিম বলেন, ‘‘আমি তো শুনলাম কচুবেড়িয়ায় নাকি ঘাট ভেঙে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দেখি, কিছুই হয়নি।’’ এমন গুজবের কথা জানিয়েছেন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরাও। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁরা হয় যথেষ্ট বয়স্ক, নয়তো অসুস্থ।’’
বস্তুত, গঙ্গাসাগরে প্রতি বছরই কিছু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সালিম বলেন, ‘‘এখানে অনেক পুণ্যার্থী আসেন যাঁরা অসুস্থ বা বয়স হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ মারা যান। তবে এ বারে প্রশাসনের তরফে চেষ্টা হয়েছে, এমন ঘটনা যেন বেশি না ঘটে। তাই গত বছরের তুলনায় এ বারে মৃত্যুর সংখ্যা অনেকটাই কম।’’
কেন্দ্র-রাজ্যে সম্পর্ক নিয়ে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরাও প্রশ্ন তুলেছেন— রাজ্যের কাছ থেকে কোনও খোঁজখবর না নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর এ ভাবে অনুদানের ঘোষণা করে দিতে পারে কি? তাঁদের আরও বক্তব্য, এই রকম ৩-৪ জন মারা গেলে পিএমও কখনওই এ ভাবে প্রতিক্রিয়া দেয় না। এর পিছনে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক নকশা রয়েছে।
সম্প্রতি নোট বাতিলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন মমতা। তাঁর আক্রমণের মূল নিশানা খোদ প্রধানমন্ত্রী। অন্য দিকে, রোজ ভ্যালি ও সারদা তদন্তে গতি বাড়িয়েছে সিবিআই। যা নিয়ে তৃণমূলের অভিযোগ, এটা প্রতিহিংসার রাজনীতি হচ্ছে। শনিবার বিজেপির রাজ্য নেতা জয়প্রকাশ মজুমদারকে প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে রাজ্যের পুলিশ। তাতে আবার বিজেপি পাল্টা সরব হয়েছে প্রতিহিংসার রাজনীতি নিয়ে।
এই ঠোকাঠুকির মধ্যে কচুবেড়িয়ায় মৃত্যু নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর টুইট দু’দলের দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করল।