জাতীয় সড়কে বাস ভাঙচুর।
বিদ্যুতের দাবিতে পথ অবরোধকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র ফরাক্কা। বোমা-গুলি-লাঠিচার্জ-পাথরবৃষ্টি-গাড়ি ভাঙচুর তীব্র উত্তেজনা ছড়াল ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সংলগ্ন বিরাট এলাকায়। অবরোধ তুলতে পুলিশ গুলি চালায় বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি। পুলিশের গুলিতে এক জনের মৃত্যুও হয়েছে। উত্তেজিত জনতার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছেন ফরাক্কার আইসি সহ মোট ন’জন পুলিশকর্মী। জখম হয়েছেন আট গ্রামবাসীও। ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে শাসক-বিরোধী চাপানউতোর।
পুলিশ সূত্রে খবর, এ দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ফরাক্কার অর্জুনপুর থানা এলাকায় জিগরি মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন প্রায় কয়েকশো এলাকাবাসী। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক নয়। গত তিন দিন ধরে এলাকা প্রায় পুরোপুরিই বিদ্যুৎহীন। অবরোধকারীদের দাবি ছিল, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীদের এলাকায় আসতে হবে। কিন্তু, ছুটির দিনে বিদ্যুৎ দফতর বন্ধ থাকায় কোনও কর্মীই এলাকায় যাননি। ফলে জনরোষ তীব্র হতে থাকে। সকাল থেকে শুরু হওয়া পথ অবরোধের জেরে জাতীয় সড়কে ব্যাপক যানজটও তৈরি হয়। অবরোধ তুলতে দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ ফরাক্কা থানার আইসি সমীররঞ্জন লালার নেতৃত্বে বিশাল পুলিশবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। অবরোধের চেহারা যে বড়সড়, তা পুলিশের জানা ছিল আগে থেকেই। তাই পার্শ্ববর্তী সুতি ও সামশেরগঞ্জ থানা থেকেও বাহিনী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পুলিশের দাবি, প্রথমে বুঝিয়ে-সুঝিয়েই অবরোধ তোলার চেষ্টা হচ্ছিল। তখনই পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে শুরু করেন অবরোধকারীরা। এমনকী, বোমাবাজিও শুরু হয়। এর পরই লাঠিচার্জ শুরু হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
লাঠি চালিয়ে অবশ্য পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পারেনি পুলিশ। উত্তেজিত জনতার সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর। ব্যাপক ইটবৃষ্টি শুরু হয়। ভাঙচুর করা হয় পুলিশের পাঁচটি গাড়িতে এবং দু’টি বাসে। এর পরই পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের দাবি, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে শূন্যে গুলি চালানো হয়েছিল। কিন্তু পুলিশের গুলিতে এক যুবকের মৃত্যু হওয়ায় শূন্যে গুলি চালানোর তত্ত্ব ধোপে টিকছে না। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করেই পুলিশ গুলি চালিয়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের দাবি।
যানজটের ফলে তখন জাতীয় জড়ক অবরুদ্ধ।
পুলিশের গুলিতে কোনও মৃত্যুর খবর অবশ্য প্রথমে প্রশাসনের তরফে স্বীকার করা হচ্ছিল না। ফরাক্কার কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হকই সর্বপ্রথম পুলিশের গুলিতে এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর জানান। মৃতের নাম জামাল শেখ এবং তিনি ফরাক্কার বলিদাপুকুরের বাসিন্দা ছিলেন, সে কথাও মইনুল হক জানিয়ে দেন। পরে মুর্শিদাবাদারে অতিরিক্ত জেলাশাসক এনাউর রহমান স্বীকার করেন, “পুলিশের গুলিতে এক জন নিহত ও এক জন আহত হয়েছেন। গোটা বিষয়টা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” জখম ব্যক্তির নাম সোলেমান শেখ। ঘটনার সময় জিগরিতে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। গোলমালের মাঝে পড়ে তাঁর ডান হাতে গুলি লাগে বলে পুলিশ সূত্রে খবর। সোলেমানকে ধূলিয়ানের অনুপনগর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সোলেমান ছাড়াও এই ঘটনায় জখম হয়েছেন আর সাত জন স্থানীয় বাসিন্দা। অন্য দিকে, অরবোধকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে ফরাক্কা থানার আইসি সমীররঞ্জন লালার মাথা ফেটেছে। তিনিও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অবশেষে অতিরিক্ত জেলাশাসক এনাউর রহমান এবং জঙ্গিপুরের এসডিপিও পিনাকী দত্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছন।
পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর খবর ছড়াতেই এক লাফে বেড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক উত্তেজনা। শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে তুমুল চাপানউতোর শুরু হয়েছে। তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেনের দাবি, “পুলিশ এলাকায় শান্তি ফেরানোর চেষ্টা করেছে।” তাঁর মন্তব্য, “ফরাক্কায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকা সত্ত্বেও এলাকার মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। তা ঝাড়খণ্ড-বিহারে চলে যাচ্ছে। ফরাক্কাবাসীরা কেন বিদ্যুৎ পাবেন না, তার জবাব কেন্দ্রকে দিতে হবে।” তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক তথা মান্নান হোসেনের ছেলে সৌমিক হোসেন অবশ্য পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসীর মৃত্যুকে ‘দুর্ঘটনা’ আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “চক্রান্ত করে, পরিকল্পনামাফিক গোটা ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে।” পুলিশের গুলিতে গ্রামবাসীর মৃত্যু প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়। গোটা ঘটনাটাই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আমরাও বিষয়টিকে খতিয়ে দেখে তার রিপোর্ট দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে পাঠাচ্ছি।”
আরও পড়ুন