গ্রেফতারির প্রতিবাদে দিনভর বিক্ষোভ

ওঁরা শিক্ষকই, বারবার ঢোঁক গিলে বলছে পুলিশ

ক্ষোভ আড়িয়াদহে। ক্ষোভ হিঙ্গলগঞ্জে। ক্ষোভ শাসক দলেও। আর বিস্ময় প্রায় সর্বস্তরে। এবং এই বিস্ময় ও ক্ষোভের প্রেক্ষিতে বারবার ঢোঁক গিলছে পুলিশ। ‘ভুল হয়ে গিয়েছে’, মুখ ফুটে সরাসরি এ কথাটা এখনও বলেনি। তবে ডাকাত সন্দেহে আট শিক্ষককে গ্রেফতারের দায় স্বীকার করে নিয়েছে তারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ব্যারাকপুর ও হিঙ্গলগঞ্জ শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৫ ০৪:০৯
Share:

বসিরহাট স্টেশনে শিক্ষকদের অবস্থান বিক্ষোভ। ছবি: নির্মল বসু।

ক্ষোভ আড়িয়াদহে। ক্ষোভ হিঙ্গলগঞ্জে। ক্ষোভ শাসক দলেও।

Advertisement

আর বিস্ময় প্রায় সর্বস্তরে।

এবং এই বিস্ময় ও ক্ষোভের প্রেক্ষিতে বারবার ঢোঁক গিলছে পুলিশ। ‘ভুল হয়ে গিয়েছে’, মুখ ফুটে সরাসরি এ কথাটা এখনও বলেনি। তবে ডাকাত সন্দেহে আট শিক্ষককে গ্রেফতারের দায় স্বীকার করে নিয়েছে তারা। ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার নীরজকুমার সিংহ রবিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘‘ধৃতেরা শিক্ষক বলে আমরা জানতে পেরেছি। সেই অনুযায়ী সোমবার আদালতকে আমাদের বক্তব্য জানাব। তার পরে যা করার, ঠিক করবে আদালতই।’’ কী করে শিক্ষকদের ডাকাত সাজানো হল, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলেও জানান পুলিশ কমিশনার।

Advertisement

সন্ধ্যায় নীরজের এই বক্তব্যের আগে শিক্ষকদের গ্রেফতারি ঘিরে সারা দিন ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলে বিভিন্ন স্তরে। আড়িয়াদহের যে-এলাকায় ওই আট শিক্ষক সদ্য ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন, সেখানকার বাসিন্দারা পুলিশের ভূমিকায় একই সঙ্গে অবাক আর ক্ষুব্ধ। ধৃত শিক্ষকদের বাড়ির এলাকা হিঙ্গলগঞ্জের মানুষের বিস্ময় আর ক্ষোভের মাত্রা তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। আর ধৃতদের পরিবারের সদস্যেরা জানান, শিক্ষকদের মুক্তির দাবিতে এবং পুলিশের ভূমিকার প্রতিবাদে প্রয়োজনে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী ও আদালতের দ্বারস্থ হবেন। এ দিন বেলঘরিয়া থানায় বিক্ষোভ দেখায় মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। ক্ষোভ দানা বেঁধেছে শাসক দলের স্থানীয় একটি অংশেও। কারণ, ধৃতদের কয়েক জন তৃণমূলেরই নেতা বা কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

পুলিশ কী করছে?

সরাসরি ভুল কবুল করেনি পুলিশ। তবে ধৃত শিক্ষকদের পরিবারের লোকজন এবং পুলিশের বিরুদ্ধে সরব বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের কাছে তারা বলেছে, শিক্ষকদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। আদালতে পেশ করা রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছিল, ওই শিক্ষকেরা ডাকাতির উদ্দেশ্যে পাটবাড়ি এলাকায় ধারালো অস্ত্র, ব্যাগ, লাঠি-সহ জড়ো হয়েছিলেন। অভিযোগকারী প্রবেশনার সাব-ইনস্পেক্টর বা পিএসআই সুকান্ত দাস এবং দুই সাক্ষী তরুণ রায় ও দিলীপ প্রধানের সঙ্গে দু’দিন ধরে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তবে ‘দুষ্কৃতী’ ধরার নামে বেলঘরিয়া থানার অফিসারদের এই কীর্তি দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে পুলিশের উঁচু মহল।

ধৃত শিক্ষকদের পরিবারের লোকেরা এ দিনও বেলঘরিয়া থানা ও ব্যারাকপুর মহকুমা জেলে যান। এপিডিআর বেলঘরিয়া থানায় বিক্ষোভ দেখায়। আইসি দেবর্ষি সিংহ তাদের আশ্বাস দেন, কেন শিক্ষকদের এ ভাবে গ্রেফতার করা হল, তার বিভাগীয় তদন্ত হবে এবং শিক্ষকদের ছাড়িয়ে আনার জন্য সোমবারেই আর্জি জানানো হবে আদালতে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, পুলিশের এমন ভুল হবে কেন? আড়িয়াদহের বাসিন্দাদের একাংশ প্রশ্ন তুলছেন, এক জায়গায় কিছু অপরিচিত মানুষ জড়ো হলেই তাঁরা ডাকাত বা জঙ্গি হবেন, পুলিশ অফিসারেরা এতটা নিশ্চিত হলেন কী করে? স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ যদি সন্দেহ প্রকাশ করেও থাকেন বা পুলিশে খবর দেওয়া হয়ে থাকে, তাতেই কি পুলিশ পত্রপাঠ গ্রেফতার করতে পারে?

যিনি ‘ডাকাতির উদ্দেশ্যে কিছু লোকের জড়ো হওয়ার খবর’ দিয়েছিলেন বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছিল, কামারহাটি পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সেই তৃণমূল কাউন্সিলর স্বপন মণ্ডল রবিবার পুলিশের সেই দাবি অস্বীকার করেন। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেন, তিনি শিক্ষকদের পাশে আছেন। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশকে আমি কিছু জানাইনি। আমি দাবি করছি, পুলিশ কী করে এই ভুল করল, তার পূর্ণ তদন্ত হোক। শিক্ষকদের এমন হেনস্থা মানতে পারছি না। অবিলম্বে তাঁদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক।’’ অস্বস্তি এড়াতে পুলিশকর্তারা এই ঘটনা নিয়ে বিশেষ মুখ খুলতে চাইছেন না। কোনও কোনও কর্তা বিভাগীয় তদন্তের কথা বলছেন, এই মাত্র।

কিন্তু তাতে ক্ষোভ চাপা পড়ছে না। শিক্ষকদের গ্রেফতারি নিয়ে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে হিঙ্গলগঞ্জের শিক্ষকদের মধ্যে। বৃহত্তর আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন তাঁদের একাংশ। শিক্ষকদের মুক্তি এবং দোষী পুলিশকর্মীদের শাস্তির দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছেন ধৃত শিক্ষকদের একাংশ। এ দিন বসিরহাট স্টেশনে প্ল্যাকার্ড হাতে বসে বিক্ষোভ দেখান কিছু শিক্ষক ও পড়ুয়া। ধৃত শিক্ষকদের কেউ কেউ তৃণমূলের নেতা-কর্মী। ডাকাতির উদ্দেশ্যে অস্ত্র নিয়ে জড়ো হওয়ার মতো অভিযোগে শিক্ষকদের গ্রেফতারি নিয়ে পুলিশের একাংশ বিব্রত। বিষয়টি নিয়ে একটু ‘বাড়াবাড়ি’ হয়ে গিয়েছে বলেই তাঁদের মত। ঘটনার কথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কানেও পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতিতে ওই শিক্ষকদের দ্রুত জামিনে ছাড়িয়ে এনে ‘সুবিচার’-এর ব্যবস্থা করার বাধ্যবাধকতা আছে বলে মনে করছে শাসক দলও। তৃণমূল সূত্রের খবর, শিক্ষকদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বড় আন্দোলন গড়ে উঠুক, দলের একাংশ তা চাইছে না।

শাসক দলে অন্য সুরও বাজছে। যেমন হিঙ্গলগঞ্জের দুলদুলি অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতি বিধান মণ্ডল পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার এলাকা থেকে দু’জন শিক্ষককে ধরা হয়েছে। শিক্ষকেরা আমাদের কাছে সব সময়েই সম্মাননীয়। তাঁদের যে-ভাবে গ্রেফতার করা হল, তার তীব্র প্রতিবাদ হওয়া উচিত।’’

ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন সুন্দরবন লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা, শিক্ষক, পড়ুয়ারা। ধৃত এক শিক্ষকের ছেলে এ দিন বলেন, ‘‘ওই আট জনই যে শিক্ষক, তার যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ যে-ভাবে ওঁদের গ্রেফতার করল, তা ক্ষমার অযোগ্য। পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। বাবার মুক্তি এবং পুলিশের শাস্তির দাবিতে আমরা শিক্ষা কাউন্সিল, শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাব।’’ আর এক ধৃত শিক্ষকের ভাইপো জানিয়ে দেন, অবিলম্বে শিক্ষকদের মুক্তি না-দিলে তাঁরা হাইকোর্টে যাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন