এত কথা কেন, ধমক খেলেন ভারতী

সবংয়ে কলেজের ভিতরে ছাত্র খুনের ঘটনার তদন্ত নিয়ে বয়ান বার বার বদল করছেন তিনি। আর তার জেরে অবশেষে ভর্ৎসিত হলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৫৪
Share:

সবংয়ে কলেজের ভিতরে ছাত্র খুনের ঘটনার তদন্ত নিয়ে বয়ান বার বার বদল করছেন তিনি। আর তার জেরে অবশেষে ভর্ৎসিত হলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ।

Advertisement

নবান্ন সূত্রের খবর, সোমবার স্বরাষ্ট্র দফতর থেকে ভারতীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁর এত কথা বলা সরকার ভাল চোখে দেখছে না। তাঁকে সবংয়ের ব্যাপারে আর কোনও সাংবাদিক বৈঠক না-করার নির্দেশও দিয়েছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘কলেজের মধ্যে এক জন ছাত্র খুন হয়েছেন। পুলিশ তদন্ত করছে। কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ সুপার এত কথা বলছেন কেন?’’

যদিও রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষকর্তার মন্তব্য, ‘‘সবংয়ের ক্ষেত্রে ভারতী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন বলে তাঁকে ভর্ৎসনা করা হল। কিন্তু সরকার ও শাসক দলের শীর্ষস্তর থেকে ক্রমাগত প্রশ্রয় পেয়েই তো তিনি এই বাড়াবাড়ি করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন।’’ প্রশাসন এবং শাসক দলের অন্দরে ভারতী খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থাভাজন বলেই পরিচিত। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, মমতাকে ‘দিদি’ বা ‘ম্যাডাম’ নয়, ‘স্যার’ বলেই সম্বোধন করেন ভারতী! সবং কাণ্ডে তিনি আগাগোড়া মুখ্যমন্ত্রীর তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালিয়েছেন। এবং সেই কাজ করতে গিয়েই মুখ পুড়িয়েছেন।

Advertisement

শুক্রবার সবংয়ের সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষে ছাত্র পরিষদ কর্মী কৃষ্ণপ্রসাদ জানার মৃত্যুর পরে নাম না-করে কৌশলে ঘটনার দায় কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের উপরেই চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ইঙ্গিত ছিল, ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। যদিও সেই দিন এফআইআরে নাম থাকা তিন তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরের দিন আদালতে আবেদন করে ‘তদন্তের প্রয়োজনে’ তাদের হেফাজতেও নেওয়া হয়। আর তার পরেই শনিবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের কাছে এসপি দাবি করেন, ‘‘সিসিটিভি ফুটেজে ওই অভিযুক্তদের দেখা যায়নি।’’ কিন্তু পরের দিন ওই সিসিটিভি ফুটেজের কিছু অংশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তাতে ওই অভিযুক্তদের সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গিয়েছে। তখন বয়ান পাল্টে ভারতী দাবি করেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, অভিযুক্তদের লাঠি হাতে দেখা যায়নি।’’

তদন্তের আগেই ধৃতদের কার্যত ক্লিন চিট দেওয়া এবং তার পর বয়ান বদলে বাধ্য হওয়ায় পুলিশের নিরপেক্ষতাই যে আরও এক বার বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে গিয়েছে, তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন প্রশাসনের কর্তারা। তাই ভারতীকে মুখে কুলুপ আঁটার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ দিন আনন্দবাজারকে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেন ভারতী।

কিন্তু এই ভর্ৎসনার জেরে ভারতীর দাপট কি কিছু কমবে? তেমন সম্ভাবনা অবশ্য দেখছেন না তৃণমূল নেতারাই। তাঁদের একাংশ কৌতুক করে বলেন, পূর্ব মেদিনীপুরে যেমন শুভেন্দু অধিকারী, কোচবিহারে রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, জলপাইগুড়িতে সৌরভ চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি তথা দার্জিলিঙে গৌতম দেব, বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল, উত্তর ২৪ পরগনায় জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক— ঠিক তেমনই পশ্চিম মেদিনীপুরে তৃণমূলের শীর্ষনেতার নাম ভারতী ঘোষ।

আর সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর আর সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘জেলার তৃণমূল নেতারাও ভারতীর মতো কট্টর তৃণমূলী নন। বিরোধীদের যে কোনও ভাবে নির্মূল করার উদ্যোগ জেলার এসপি-র মধ্যে যতটা, তৃণমূল নেতাদের মধ্যে ততটা নেই।’’

ডব্লিউবিপিএস থেকে ২০০৬-এ আইপিএস হওয়া অর্থাৎ পুলিশি পরিভাষায় ‘প্রোমোটি আইপিএস’ ভারতী ঘোষ-ই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা এসপি। ২০১২-র এপ্রিলে ঝাড়গ্রাম পুলিশ জেলার এসপি হন তিনি। তার পর ২০১৩-র অগস্টে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার, সঙ্গে ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত দায়িত্ব। এর পরই ধীরে ধীরে জেলা তৃণমূলের কার্যত সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন ভারতী। জেলার এক তৃণমূল নেতার বক্তব্য, ‘‘এসপি হয়ে উনি (ভারতী) দলের কাজকর্মেও মাথা গলান। কয়েক জন প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের শুনতে হয়েছে, বেশি বেগড়বাই করলে দলীয় পদ হারাতে হবে।’’

তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের কাজে ভারতীর ‘মাতব্বরিতে’ অতিষ্ঠ হয়ে জেলার কিছু বর্ষীয়ান নেতা কিছু দিন আগে দল তথা সরকারের শীর্ষস্তরে ভারতীর অপসারণ চেয়ে দরবার করতে যান। কিন্তু তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়, কে এসপি থাকবেন, না থাকবেন, সে নিয়ে তাঁদের মতামত থাকতে পারে না। তার পর থেকে ওই নেতারা স্রেফ গুটিয়ে গিয়েছেন। তাঁদেরই এক জনের খেদোক্তি, ‘‘দলের লোক হয়েও পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে আমাদের কার্যত অস্তিত্ব নেই। দলটা এসপি-ই চালাচ্ছেন।’’

তবে শুধু তৃণমূল জমানা নয়, আগের বাম আমলেও শাসক দলের উপর মহলের সঙ্গে ভারতীর দহরম মহরম ছিল। সিপিএম সূত্রের খবর, পার্টির এক বর্ষীয়ান নেতাকে তিনি ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করতেন এবং একটা সময় দিনে ও রাতে তাঁর খাবার যেত ভারতীর বাড়ি থেকে। আবার আর এক সিপিএম শীর্ষ নেতার সঙ্গে তিনি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দেখা করতে যেতেন। ভারতী তখন সিআইডি-র ডিএসপি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তখন জ্যোতি বসু। কিন্তু আসল ক্ষমতা যে ওই নেতারই হাতে, তা ভারতী বুঝে যান বলে সিপিএম সূত্রের খবর। সিনিয়র এক আইপিএস অফিসারের কথায়, ‘‘ক্ষমতার আধারকে চিনে নিয়ে দ্রুত তাঁর আস্থাভাজন হতে পারার অদ্ভুত দক্ষতা ও মুন্সিয়ানা রয়েছে ভারতীর।’’

তবে বাম আমলেই সিআইডি থেকে ভারতীকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করে দেওয়া হলে তিনি যেতে অস্বীকার করেন বলে পুলিশ সূত্রের খবর। তখন তাঁকে বদলি করা হয় আইবি-তে। সেখান থেকে বিদেশে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অঙ্গ হিসেবে ভারতী কসোভো, ইরাক, সোমালিয়ায় কাজ করেছেন। দেশে ফিরে তৃণমূল জমানায় ঝাড়গ্রামের অতিরিক্ত এসপি হন। অচিরেই আস্থাভাজন হন সেই সময় শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এক সাংসদের।

পশ্চিম মেদিনীপুরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে ওই সাংসদের সঙ্গে অহিনকুল সম্পর্কে থাকা তৃণমূলেরই আর এক সাংসদ তখন বলেছিলেন, ‘‘আমার নিরাপত্তা রক্ষীদের সব সময় মোবাইল বন্ধ রাখতে বলি। কারণ, ঝাড়গ্রাম পুলিশ ওঁদের মোবাইল টাওয়ারের অবস্থান দেখে আমি কোথায় আছি, সেটা বার করে নেয়।’’

যে সাংসদের হাত ধরে তৃণমূলে তাঁর প্রভাব বিস্তার, তিনি দলে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ায় দলের আরও উঁচু মহলে পৌঁছে যান ভারতী। এ ক্ষেত্রে তাঁর সহায় হন কলকাতার বাসিন্দা এক মন্ত্রী। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আশীর্বাদে ভারতী পশ্চিম মেদিনীপুরে একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু করেন বলে অভিযোগ। পক্ষপাতের অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। গত জুনে বিজেপি ও সিপিআইয়ের কাউন্সিলরদের ভাঙিয়ে খড়্গপুরে পুরবোর্ড গড়ে তৃণমূল। বিরোধীরা অভিযোগ করেন, কাউন্সিলর ভাঙানোর ক্ষেত্রে এসপি-ই মুখ্য ভূমিকা নেন। পুলিশ সূত্রেরও খবর, তৃণমূলের পুরবোর্ড দখল নিশ্চিত করতে নজিরবিহীন ভাবে খড়্গপুরে অস্থায়ী অফিস পর্যন্ত করেছিলেন এসপি।

আরও একটি নজিরবিহীন ঘটনার কথা জানাচ্ছেন রাজ্য পুলিশ কর্তাদের একাংশ। প্রোমোটি আইপিএস-দের ক্ষেত্রে জুনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ গ্রেড
(জেএজি) পাওয়ার জন্য পুলিশ অ্যাকাডেমিতে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ নিতে হয়। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে চার বছর ওই প্রশিক্ষণের জন্য কোনও অফিসারকেই ছাড়েনি সরকার।

কিন্তু জানুয়ারিতে ওই গ্রেড প্রাপকের তালিকায় যুক্ত হয় ভারতী ঘোষের নাম। এর পরেই নবান্নের শীর্ষ কর্তাদের নির্দেশে ভারতী-সহ একসঙ্গে ২৫ জন প্রোমোটিং অফিসারকে ওই গ্রেড দেওয়া হয়। গ্রেড পাওয়া বাকি অফিসারদের এক জনের কথায়, ‘‘এ ভাবে প্রশিক্ষণ ছাড়া গ্রেড দেওয়া কখনওই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অনুমোদন করে না। কেউ যদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে অভিযোগ জানান, তা হলে কিন্তু আমাদের কপালে দুর্গতি লেখা আছে।’’

আজ, মঙ্গলবার দিল্লির সংসদ চত্বরে বাম সাংসদদের ধর্না কর্মসূচি অছে। সেখানে ভারতী ঘোষের আইপিএস পদ কেড়ে নেওয়ার দাবিও থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন